আইএস–আতঙ্ক কি ফিরে আসছে
গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। নীল স্যুট, লাল টাই আর বাদামি রঙের জুতা পরে এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে আছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ইয়ান ম্যাকক্যারি। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পরাজয়ের পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে এই আয়োজন করেছিল চিন্তন প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট’। সেখানে অতিথি ছিলেন ম্যাকক্যারি।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং এই জোটের হয়ে কাজ করা স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষের অব্যাহত হামলার মুখে ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ সিরিয়ার বাঘুজ থেকে বিতাড়িত হয় আইএস। ওই ঘটনার পাঁচ বছর পূর্তির দিনের অনুষ্ঠানে ইয়ান ম্যাককারি বলেন, ‘আইএস যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার মাইলফলক ছিল দিনটি এবং তা মাইলফলক হয়ে থেকে যাবে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফগানিস্তানে একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করতে না পারলে আইএসকেপির পক্ষে এসব হামলার কোনোটিই চালানো সম্ভব হতো না। তালেবানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের পরও ২০২১ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পরই মূলত দেশটিতে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে আইএস।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ম্যাককারির এমন মন্তব্যের এক দিন পরেই শুক্রবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় একটি জনাকীর্ণ হলে হামলা চালায় এক দল বন্দুকধারী। কনসার্ট দেখতে সেই হলে আসা কয়েক হাজার সংগীতপ্রেমীকে লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি করে বন্দুকধারীরা। কনসার্ট হলটিতে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা।
এ হামলায় অন্তত ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত তিনটি শিশু রয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। গত দুই দশকের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা এটি।
সেদিনই এই হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট–খোরাসান প্রভিন্স (আইএসকেপি)। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আফগানিস্তান শাখা হচ্ছে এই আইএসকেপি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তাদের গোয়েন্দা তথ্যমতে আইএসকেপির এই দাবির সঠিক।
হামলার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে আইএসকেপি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়া ও ইরাকে পরাজয়ের পর আইএসের ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত এই হামলা। একই সঙ্গে আইএস যে উদ্দেশ্য হাসিলে কাজ করছে, তা পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে আফগানিস্তানের।
তালেবান হামলা চালিয়ে কারাগার ভেঙেছিল। সেই সুযোগে আইএসকেপির অনেক যোদ্ধা কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত আফগান সামরিক বাহিনীর পতন আইএসকেপির জন্য সুযোগ হয়ে এসেছিল। কারণ, এতে করে পরাজিত আফগান বাহিনীর অস্ত্র লুট করার সুযোগ পায় আইএসকেপি।
২০২৩ সালে ‘দ্য ইসলামিক স্টেট ইন আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান: স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সেস অ্যান্ড রাইভালরিস’ নামের একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির দুই লেখকের একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার ক্লেমসন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমিরা জাদুন। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘রাশিয়ায় হামলার জন্য যদি নিশ্চিতভাবেই আইএসকেপি দায়ী হয়, তাহলে তারা যে লক্ষ্যের কথা বলে আসছে, তার সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবধান ছিল সেটা পূরণের ইঙ্গিত দেয়। আইএসকেপির সেই লক্ষ্য হলো মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা।’
মস্কোয় হামলার দুই মাস আগে ইরানের কেরমান শহরে আত্মঘাতী এক বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় ৯০ জনের বেশি নিহত ও প্রায় ৩০০ জন আহত হন। সেই হামলার দায়ও স্বীকার করেছিল আইএসকেপি।
আমিরা জাদুনের মতে, আইএস মনে করে চেচনিয়া, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে (গত শতকের আশিক দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের সময়) মুসলিমদের ওপর জুলুমকারী একটি রাষ্ট্র রাশিয়া। শিয়া অধ্যুষিত ইরানও দীর্ঘদিন ধরে আইএসের মাথাব্যথার কারণ। এসব কারণে সাম্প্রতিক এই দুই হামলার নেপথ্যে আইএসের কৌশলগত লক্ষ্য কাজ করেছে বলে মনে করেন তিনি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান ও রাশিয়ার মতো দেশে হামলা চালিয়ে আইএসকেপি শুধু আঞ্চলিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকা দেশগুলোর মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছে না, একই সঙ্গে বৈশ্বিক পর্যায়ে তারা যে তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা রাখে এবং তাদের যে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা আছে, সেটিও তুলে ধরতে চাইছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফগানিস্তানে একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করতে না পারলে আইএসকেপির পক্ষে এসব হামলার কোনোটিই চালানো সম্ভব হতো না। তালেবানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের পরও ২০২১ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পরই মূলত দেশটিতে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে আইএস।
তালেবানের উত্থানে সুবিধা পায় আইএসকেপি
আইএসের অবস্থান যখন সবচেয়ে ভালো ছিল, তখন গোষ্ঠীটি সিরিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ ও ইরাকের ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক প্রভাবশালী পক্ষগুলোর পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাক সরকারের সামরিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে এসে নিজেদের দখলে থাকা ভূখণ্ডের প্রায় ৯৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ হারায় আইএস। ২০১৯ সালের মার্চে এসে বাঘুজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পড়ে গোষ্ঠীটি। বাঘুজের পতনের পর সিরিয়া ও ইরাকের কোনো ছোট–বড় শহর ও অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ছিল না আইএসের।
আইএসকেপির হুমকি মোকাবিলায় ন্যাটোর সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর কৌশল ছিল বিমান হামলা। কিন্ত ন্যাটোর বিমান হামলা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা এই জঙ্গি গোষ্ঠীকে সংহত হওয়ার আরও সুযোগ তৈরি করে দেয়।মাইকেল কুগেলম্যান, পরিচালক, ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আইএসকেপি প্রাণঘাতী একটি শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে থাকে। ২০২০ সালের মে মাসে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে হামলায় নারী ও শিশুসহ ২৪ জন নিহত হন। এ হামলার জন্য আইএসকেপিকে দায়ী করা হয়েছিল। এর ছয় মাস পর কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায় আইএসকেপি। এতে অন্তত ২২ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিহত হন।
এরপর আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন ও মার্কিন বাহিনীর তাড়াহুড়া করে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলা চালায় আইএসকেপি। সে হামলায় অন্তত ১৭৫ জন বেসামরিক নাগরিক ও ১৩ জন মার্কিন সেনা নিহত হন।
২০১৯ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য আইএসআইএস পেরিল’–এর লেখক ও নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো কবির তানেজা বলেন, আফগানিস্তানে আইএসকেপির শক্তি–সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আইএসকেপি শুধু আফগানিস্তানেই থেমে থাকেনি। পাকিস্তানেও হামলা করেছে। গত জুলাইয়ে পাকিস্তানে এক নির্বাচনী সমাবেশে হামলা চালায় গোষ্ঠীটি। সেই হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন আইএসকেপির জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
কুগেলম্যান আল–জাজিরাকে বলেন, আইএসকেপি তালেবানের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। কিন্তু তালেবানের রাষ্ট্রক্ষমতায় ফেরা এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে সুবিধা পেয়েছে গোষ্ঠীটি। তিনি বলেন, তালেবান হামলা চালিয়ে কারাগার ভেঙেছিল। সেই সুযোগে আইএসকেপির অনেক যোদ্ধা কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত আফগান সামরিক বাহিনীর পতন আইএসকেপির জন্য সুযোগ হয়ে এসেছিল। কারণ, এতে করে পরাজিত আফগান বাহিনীর অস্ত্র লুট করার সুযোগ পায় আইএসকেপি। আর তালেবানের কোনো বিমানবাহিনী না থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের দখল ও সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা আইএসকেপির জন্য সহজ হয়েছে।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আইএসকেপির হুমকি মোকাবিলায় ন্যাটোর সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর কৌশল ছিল বিমান হামলা। কিন্ত ন্যাটোর বিমান হামলা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা এই জঙ্গি গোষ্ঠীকে সংহত হওয়ার আরও সুযোগ তৈরি করে দেয়। কারণ তালেবানের আকাশপথে হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। এতে আফগানিস্তানে অনুকূল পরিবেশ পায় আইএসকেপি এবং নিজেদের ঘাঁটি ছাড়াও অন্যত্র প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায় তারা।
নতুন চাওয়া
কবির তানেজার মতে, শুধু আইএসকেপি নয়, এই সময়ে আইএসেরও প্রভাব বেড়েছে। আল–জাজিরাকে কবির তানেজা বলেন, মূলত যেসব অঞ্চলে আইএস অভিযান চালিয়ে থাকে, সেই সিরিয়া ও ইরাকে গোষ্ঠীটির অভিযান চালানোর সক্ষমতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। আইএস এখন পরাজিত একটি গোষ্ঠীর মতো অবস্থায়। তারা রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অবস্থানগত দিক থেকে অতটা শক্তিশালী না থাকলেও আদর্শিক জায়গা থেকে এখনো শক্তিশালী।
আমিরা জাদুন বলেন, নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া, প্রভাব–প্রতিপত্তি বাড়ানো ও কৌশলগতভাবে বিচিত্র ক্ষমতার অধিকারী একটি গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার জন্য রাশিয়া ও ইরানে হামলা আইএসকেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বাইরে অন্যান্য দেশে হামলা চালিয়ে কার্যত বৈশ্বিকভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার কাজটি করতে চাইছে আইএসকেপি।