ভূমিকম্পদুর্গত এলাকায় এখনো কেন জনপ্রিয় এরদোয়ান
‘আমরা একা। বৃষ্টি হচ্ছে। বিধ্বস্ত ভবনের সামনে আমরা অপেক্ষা করছি। কেউই আমাদের সাহায্য করতে আসেনি,’ তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাহরামানমারাস শহরে একটি তাঁবুর রান্নাঘরে অন্যান্য নারীর সঙ্গে বসে ভূমিকম্পের সময়কার দুঃসহ কষ্টের কথা বলছিলেন ফাতেমা।
এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষের মুখে সেই বিপর্যয়ের সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে এমন আর্তনাদ শোনা যায়। তখন সময়মতো মানুষের সহায়তায় এগিয়ে না আসায় সবাই মোটামুটি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকারকে দায়ী করে থাকেন। ভবনের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তখন অনেক মানুষকে বারবার বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘কোথায় রাষ্ট্র?’
সেই কাহরামানমারাস হচ্ছে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) শক্ত ঘাঁটি। এই প্রদেশের আটটি সংসদীয় আসনের সাতটিই একে পার্টি ও তাদের মিত্র ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) দখলে। তবে ভূমিকম্পে সরকারের পদক্ষেপের পর এই অঞ্চলের মানুষ বর্তমান প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করবেন, এমন আশা কেউ করেন না।
তিন মাস আগে ৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল কাহরামানমারাস। ওই ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কে প্রায় ৫১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আগামীকাল রোববার তুরস্কে নির্বাচন। তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনে করা হচ্ছে এই নির্বাচনকে।
‘আমরা বাসা ভাড়া করতে পারি না’
আশ্রয়শিবিরের বাইরে ভূমিকম্পে গৃহহীন ফাতেমার মতো অন্যদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছিল একটি স্থানীয় এনজিও। এখনো ধ্বংসস্তূপ কাহরামানমারাস। কোথাও গর্ত, কোথাও আবর্জনার স্তূপ, কোথাও ভাঙাচোরা ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
ভূমিকম্পের পর যা কিছু হয়েছে, তা নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন ফাতেমা এবং বলে দিলেন, তাঁর নাম যেন প্রকাশ করা না হয়। তিনি বলেন, ‘তাঁর স্বামী এখনো অসুস্থ। আমরা আশ্রয়শিবিরে থাকতে পারছি না। তাই এক বন্ধু আমাদের তাঁর বাড়িতে রেখেছেন। কিন্তু এভাবে কত দিন থাকা যায়? কীভাবে আরেকজনের বোঝা হয়ে আমরা থাকতে পারি?’
সেলুনের এই কর্মী (৫০) বলেন, পিঠের ব্যথার কারণে তাঁর স্বামী কাজ করতে পারেন না। এই বিপর্যয়ের পর তিনিও তাঁর সব গ্রাহক হারিয়েছেন।
ফাতেমা ভূমিকম্পের পর সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমরা এখন বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য রাখি না। যে বাসার ভাড়া ছিল ৫ হাজার লিরা (২৫৫ মার্কিন ডলার), এখন সেই বাসার ভাড়া ৭ থেকে ৮ হাজার লিরা।’
ফাতেমা বলেন, ‘সরকার ঠিকমতো ত্রাণ সাহায্য বিতরণ করছে না। তাদের দেখা উচিত, কার সহায়তা দরকার, কার দরকার নয়।’
‘কিছু লোক দায়ী’
রাজনৈতিক মেরুকরণ আর আসন্ন নির্বাচনে ভূমিকম্পের প্রভাব যে কিছুটা পড়েছে, তা ইতিমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। আঙ্কারা ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সরকার সমর্থক দাবি করছেন, ভূমিকম্পের পর সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ ছিল। আবার সরকারবিরোধী ৯০ শতাংশ বলছেন, সরকার ব্যর্থ।
ভূমিকম্প উপদ্রুত ১১টি অঞ্চলের মানুষের উপলব্ধি, দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা একই রকম।
ব্যবসায়ী মেসুত ইসলামোগলু (৪৩) ভূমিকম্পের পর কিছুদিন হলো শিপিং কনটেইনারে চশমার দোকান সাজিয়েছেন। ১৮ বছর ধরে তিনি এ ব্যবসা করছেন। যে ভবনে তাঁর দোকান ছিল, সেটা ভূমিকম্পে মাটিতে মিশে গেছে।
চশমার দোকানের এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি মনে করি, বিপর্যয়ের জন্য কিছু লোক দায়ী, যাঁরা ভবন নির্মাণের নিয়ম মানেননি।’ তিনি বলেন, তাঁর ব্যবসা ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েক সপ্তাহ ধরে আবার এলাকায় ফিরছেন।
‘তিনি একজনই’
এরদোয়ানের জোট ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সে ছয়টি দল রয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতৃত্বে রয়েছেন কেমাল কিলিচদারোগলু।
কয়েক সপ্তাহ ধরে দুজনের মধ্যে নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এরদোয়ানের চেয়ে এখনো সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন কেমাল। তবে অনেকের ধারণা, প্রথম পর্বের কেউই পর্যাপ্ত ভোট পাবেন না। ২৮ মে দ্বিতীয় পর্বের ভোটে যাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
এরদোয়ানবিরোধী জোটে যেমন আছে ধর্মনিরপেক্ষ দল, তেমনি আছে ইসলামপন্থী ও এরদোয়ানের জোট থেকে বেরিয়ে আসা দল। তারা জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তুরস্কে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হবে। এরদোয়ানের অপ্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করা হবে। তাদের দাবি, তাঁর ভুল নীতির কারণে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। লিরা প্রায় ৭০ শতাংশ দর হারিয়েছে।
তবে ব্যবসায়ী মেসুত বলছেন, ‘আমি এরদোয়ানের ওপর আস্থা রাখি। আমরা ভূমিকম্পে ১১টি শহর হারিয়েছি। আমি মনে করি, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আবার এসব শহর গড়ে তুলতে পারবেন।’
নীরব প্রচার
কাহরামানমারাস শহর কেমাল আর এরদোয়ানের বিলোবোর্ড, পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এরদোয়ানের বিলবোর্ড–পোস্টারে স্লোগান, ‘শতাব্দীর সংহতি’। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ঘোমটা দেওয়া কান্নারত এক নারীকে এরদোয়ানের আলিঙ্গনের ছবি। পোস্টারে দাবি করা হয়েছে, ভূমিকম্পদুর্গতদের জন্য রাষ্ট্র সবকিছু করছে।
ভূমিকম্পে প্রায় দুই লাখ ভবন ধ্বংস হয়েছে বা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দেশের প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে জাতিসংঘ বলছে।
ভূমিকম্পদুর্গত অঞ্চলে দুই শিবিরই নীরবে প্রচার চালাচ্ছে। এখানে কোনো শোভাযাত্রা নেই, বাস বা অন্য কোনো পরিবহন নিয়ে প্রচার নেই।
সিএইচপির স্থানীয় নেতা আলী ওজতুনচ বলেন, ‘আমরা দুর্গত মানুষের কথা ভেবে কেবল ভোটারদের সঙ্গে বৈঠক করছি। এই অঞ্চল থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ চলে গিয়েছিল। এখন প্রায় অর্ধেক ফিরে এসেছে।’
আলী বলেন, স্থানীয় মানুষ একে পার্টির স্থানীয় নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কিন্তু ভোটাররা এখনো এরদোয়ানের প্রতি অনুগত।
আলী বলেন, স্থানীয় মেয়র, তাঁদের ডেপুটিদের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ। এরদোয়ানের প্রতিটি উদ্যোগ ৭০ ভাগ ব্যর্থ।
আলী আরও বলেন, এই প্রদেশের ভোটাররা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর আশা, তাঁরা হয়তো প্রেসিডেন্ট পদে এরদোয়ানকে ভোট দেবেন। তবে সংসদের ভোটটি বিরোধী প্রার্থীকে দেবেন।
ফাতেমাও যেমনটা বলছিলেন। তিনি এরদোয়ানের মাঝের নামটি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমি মনে করি না, সরকার আমাদের হতাশ করবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমি তাইয়েপকে ভোট দেব। তবে সংসদ নির্বাচনের ভোট আমি অন্য কাউকে দেব।’