ইউরোপের আতঙ্ক এখন রুশ গোয়েন্দারা
গত বছরের শেষ দিকে পশ্চিম ইউরোপে ঘটে যাওয়া কয়েকটি নাশকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা ঘিরে রাশিয়ার ওপর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি ঘিরে এখন ইউরোপের দেশগুলো নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে শুরু করেছে। রাশিয়ার স্বার্থে আঘাত হানা দুটি ঘটনার পর থেকে ইউরোপে নাশকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা বাড়তে দেখা যায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তবে কোনো প্রমাণ ছাড়াই একে যুক্তরাজ্যের নাশকতা বলে দোষারোপ করে ক্রেমলিন। অন্যদিকে ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে প্রমাণ ছাড়াই রাশিয়াকে দোষারোপ করা হয়।
গত ৭ অক্টোবর কার্চ সেতুতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে মস্কোর জন্য ক্রিমিয়ায় রসদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়। এ হামলার জন্য রাশিয়া ইউক্রেনের গোয়েন্দা বাহিনীকে দোষারোপ করে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজে ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এজেন্ট। তিনি ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে নাশকতা কাজের জন্য পারদর্শী ইউনিট ২৯১৫৫ নেটওয়ার্ক পুনজ্জীবিত করেন।
কাকতালীয় মনে হলেও কার্চ সেতুতে হামলার পরদিনই উত্তর জার্মানিতে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। কারণ, ওই দিনই ট্রেন চালকদের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত কেব্লে নাশকতার ঘটনা ঘটে। এর জন্য জার্মানি কাউকে দোষারোপ না করলেও দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী ফলকার ভিসিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটা স্পষ্ট যে ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ কাজ করা হয়েছে।
এর দুই দিন পরই ডেনমার্কের ব্রনহোম শহর বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুইডেন থেকে যে তারের মাধ্যমে সেখানে বিদ্যুৎ নেওয়া হয়, তাতে নাশকতার ঘটনা ঘটে। ১৯ অক্টোবর ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে তিন এলাকায় ইন্টারনেটের তার নষ্ট হয়। ক্লাউড নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান জেডস্ক্যালার দাবি করে, ওই দিন ইন্টারনেট–সংযোগ কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ওই সংযোগ ব্যবহার করে মার্সেই শহরের সঙ্গে লিওঁ, বার্সেলোনা ও মিলান শহরের মধ্যে যোগাযোগ করা হয়। এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর আগে গত এপ্রিলেও ফ্রান্সে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।
অক্টোবরে নরওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী জানায়, তাদের জ্বালানি অবকাঠামো ও বিমানঘাঁটিগুলোর কাছ দিয়ে সন্দেহজনক ড্রোন ওড়ার ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে লিথুয়ানিয়ার পক্ষ থেকেও তাদের সামরিক ক্ষেত্রগুলো লক্ষ্য করে সন্দেহজনক ড্রোন চলাচল বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।
ইউনিট ২৯১৫৫
ইউরোপজুড়ে এসব ঘটনায় ইউনিট ২৯১৫৫–এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ইউনিট ২৯১৫৫ হলো রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের একটি শাখা। দেশের বাইরে ছদ্মবেশে কাজ করা গোয়েন্দারা এই শাখার অধীন পরিচালিত হন।
পশ্চিমা বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নাশকতার পাশাপাশি পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে যে ধরনের হামলা হয়েছে, তাতে ইউনিট ২৯১৫৫–এর কার্যক্রমের মিল রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টাল ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের অধ্যাপক জোসেফ ফিটসানাকিস বলেন, যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় তাতে ইউনিট ২৯১৫৫ নামের এই গোয়েন্দা শাখা অন্তত ২০০৯ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এ শাখার সদস্য খুবই অল্প, সম্ভবত ২০০-এর মতো। এর বাইরে এটি পরিচালনার জন্য ২০ থেকে ৪০ জন কর্মকর্তা থাকতে পারেন।
ফিটসানাকিস আল-জাজিরাকে বলেন, এই গোয়েন্দা শাখার শিকড় রয়েছে সোভিয়েত আমলের এজেন্টদের নেটওয়ার্কগুলোয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমাদের মধ্যে বৈরিতার সময় শত্রুপক্ষে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা ছিল গোয়েন্দাদের কাজ। এখন ইউনিট ২৯১৫৫-এর সদস্যরাও সেটাই করছেন।
পক্ষত্যাগী রুশদের ভাষ্যমতে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজে ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এজেন্ট। তিনি ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে নাশকতা কাজের জন্য পারদর্শী ওই নেটওয়ার্ক আবার পুনজ্জীবিত করেন এবং নতুন ইউনিট হিসেবে ২৯১৫৫ গঠন করেন।
ফিটসানাকিস আরও বলেন, পুতিনের এই ইউনিটের মিশনের লক্ষ্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধে এই নেটওয়ার্কের শক্তিশালী ভূমিকার কারণে এখনকার প্রেক্ষাপটে রুশ হাইব্রিড অভিযানে এসব গোয়েন্দার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমা বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নাশকতার পাশাপাশি পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে যে ধরনের হামলা হয়েছে, তাতে ইউনিট ২৯১৫৫–এর কার্যক্রমের মিল রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া যুদ্ধ ও বর্তমান যুদ্ধে যদি ওই ইউনিটকে ব্যবহার করা না হয়, তবে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক ঘটনা হবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও হেগ সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক আর্থার পিবি লড্রেন বলেন, এসব ঘটনায় রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করা কঠিন হলেও ফ্রান্সের নাশকতার ক্ষেত্রে যে পেশাদারত্ব দেখা গেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট গোয়েন্দাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়।
ইউরোপের জবাব
এক বছর আগে যুক্তরাজ্যের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ টনি রাডাকিন ইন্টারনেট কেব্লের আশপাশে রুশ সাবমেরিনের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডাউনার অক্টোবরে দ্য স্পেকটেটর নামের একটি গণমাধ্যমে লিখেছিলেন, বিশ্বের ৯৫ শতাংশ ইন্টারনেট ট্রাফিক পানির নিচে থাকা মাত্র ২০০টি ফাইবার অপটিক কেব্ল ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত করে। এর মধ্যে বৈশ্বিক চেকপয়েন্ট আছে ১০টি, যেখানে কেব্লগুলো একত্র হয় বা যে পয়েন্ট উপকূলে উঠে আসে। যুক্তরাজ্যকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে এসব চেকপয়েন্টে নাশকতা করাটা খুব কঠিন ব্যাপার হবে না।
এই হুমকি প্রতিরোধে ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে ইউরোপ। ২০২০ সালে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর পক্ষ থেকে দুটি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এর একটি জার্মানি ও আরেকটি যুক্তরাজ্যে। এতে সাবমেরিনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অক্টোবরে ফ্রান্স জানায়, তারাও পানির নিচের তার পর্যবেক্ষণে বিশেষ যান কিনেছে।
গত ২২ নভেম্বর সুইডেনের পুলিশ ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্য সন্দেহে এলেনা কুলকোভা ও সের্গেই স্কভোরস্তোভ নামের দুজনকে আটক করে। তাঁদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়। রুশ এই যুগল ১৯৯৭ সাল থেকে সুইডেনে বসবাস করছিলেন। তাঁরা দীর্ঘদিন নজরদারিতে ছিলেন। তাঁরা মস্কোর যে ঠিকানা ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে অনেক রুশ গোয়েন্দারও বসবাস। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইউনিট ২৯১৫৫–এর প্রধান জেনারেল আন্দ্রে এভেরিয়ানোভ এবং মেজর জেনারেল ডেনিস সার্গেভ। যুক্তরাজ্যের সাবেক রুশ গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তাঁর মেয়ের ওপর বিষ প্রয়োগের পেছনে মেজর জেনারেল ডেনিস সার্গেভই মূল ব্যক্তি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
নরওয়েতেও প্রধানমন্ত্রী ইয়োনাস গহর স্টোর বলেন, তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি বাড়াচ্ছেন। তবে অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, কোনো দেশই সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক অবকাঠামো রক্ষা করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। গ্রিসের জ্বালানিবিশেষজ্ঞ মাইক মারিয়ানথিস বলেন, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে বোমা হামলা করে কিটভর্তি বদ্ধ ডালা কেউ খুলে দিয়েছে। নর্ড স্ট্রিম নাশকতা রাশিয়ান-জার্মানির সম্পর্ক নষ্ট করেছে। অবকাঠামোর ওপর হামলা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে এবং বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে।