প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর ভাগনার বাহিনী টিকিয়ে রাখা রাশিয়ার জন্য কতটা চ্যালেঞ্জের
রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তারপরও আধা সামরিক বাহিনী ভাগনার গ্রুপকে সচল রাখতে আগ্রহী মস্কো। বিশেষ করে আফ্রিকায় তাদের কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখতে চায় মস্কো।
২০১৪ সাল থেকে আফ্রিকায় বেসরকারি ভাড়াটে বাহিনী ভাগনার গ্রুপ দিয়ে সামরিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে রাশিয়া।
লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও মালিতে সেসব দেশের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভাগনার বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ভাগনার বাহিনী ভুয়া তথ্য ছড়ায় এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার কাজটি করে দেয়।
আর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই গ্রুপ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খনিজ সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করে থাকে। তাদের দিয়ে খনিজ সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের কাজটিও করে থাকে রাশিয়া।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ভাগনার গ্রুপের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা রাশিয়ার নেই।
প্রিগোশিনকে শেষ ক্যামেরার সামনে দেখা যায় গত সোমবার। এতে তিনি সামরিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় অ্যাসাল্ট রাইফেল হাতে ছিলেন। ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, তিনি আফ্রিকায় আছেন, সেখানে তিনি রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছেন।
গত জুনে ক্রেমলিনের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর সেটাই ছিল প্রথম ভিডিওর মাধ্যমে প্রিগোশিনের জনসমক্ষে আসা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রিগোশিনের মৃত্যুর সঙ্গে সেই অভ্যুত্থানচেষ্টার সম্পর্ক থাকতে পারে।
কেমন হবে উত্তরাধিকার
মার্কিন চিন্তক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের আফ্রিকা অঞ্চলের পরিচালক রামা ইয়াদে বলেন, ভাগনারকে দিয়ে বা ভাগনারকে ছাড়া আফ্রিকায় বাণিজ্য ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয় টিকিয়ে রাখতে চায় রাশিয়া। এটাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
আফ্রিকা মহাদেশের ওপর প্রভাব ধরে রাখার জন্য ক্রেমলিনের আরও অনেক চ্যানেল আছে। এসব চ্যানেলের মধ্যে রয়েছে রুশ দূতাবাস থেকে বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অর্থোডক্স গির্জা।
ভাগনার বিশেষজ্ঞ ও ভাড়াটে বাহিনী নিয়ে শিগগিরই প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের লেখক লু ওসবর্ন বলেন, এসব চ্যানেল আফ্রিকায় ভাগনারের সাফল্যে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ওসবর্ন বলেন, ভাগনার হচ্ছে রাশিয়ার নব্য–উনিবেশবাদের গাড়ি এবং এই গ্রুপকে বন্ধ করে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
ভাগনারকে দিয়ে বা ভাগনারকে ছাড়া আফ্রিকায় বাণিজ্য ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয় টিকিয়ে রাখতে চায় রাশিয়া। এটাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য
তবে প্রিগোশিনের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লড়াই এত সহজ কাজ হবে না।
হাডসন ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক পিটার রাউ বলেন, আফ্রিকায় থাকা প্রিগোশিনের অবস্থান কোনোভাবে ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ক্রেমলিনের নেই। তবে প্রিগোশিনের স্থলাভিষিক্ত কাকে করা হবে, এতে ভাগনার গ্রুপ দুর্বল নাকি সবল হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
প্রিগোশিনের স্থলাভিষিক্ত করা সহজ নয়
নিউইয়র্কভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান সউফন সেন্টার বলছে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, প্রিগোশিন তাঁর ভাগনার গ্রুপকে বেশ জটিল এক ব্যবস্থায় পরিচালনা করতেন। এমনকি ক্রেমলিনও সত্যিকারভাবে বুঝে উঠতে পারছে না, কতটা জটিল ব্যবস্থায় তিনি গ্রুপটি পরিচালনা করতেন।
ভাড়াটে বাহিনী নিয়ে বই লিখছেন, এমন এক গবেষক জন লেচনার। তিনিও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
লেচনার বলেন, আফ্রিকায় ভাগনার গ্রুপের দায়িত্ব দিতে এমন কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে, যাঁর এমন নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং যাঁর এমন দল পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ভাগনার ২০১৭ সাল থেকে ধীরে ধীরে তাদের প্রভাববলয় তৈরি করেছে। সে দেশের সংবিধান পুনঃপ্রণয়নের পর গত জুলাইয়ে গণভোট আয়োজনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল ভাগনার বাহিনী।
লেচনার বলেন, নতুন কাউকে প্রিগোশিনের স্থলাভিষিক্ত করা হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে বর্তমান কর্মকর্তারা থাকতে পারেন। কারণ, তাঁদের নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে তাঁদের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিন্তু প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ খালি হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এসব পদ যাকে–তাকে দিয়ে পূরণ সহজ কাজ নয়।
রাশিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেনিস করোতকোভ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, এমন অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁরা এই কঠিন কাজের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাবেন, যদি তাঁদের যথাযথ আর্থিক সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হয়।’
ডেনিস বলেন, কিন্তু তাঁদের কেউই প্রিগোশিনের ধারেকাছেও যেতে পারবেন না।
ভাগনার ‘একমাত্র বিকল্প’
ভাগনার গ্রুপের অংশীজনদের কাছে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ আফ্রিকায় ভাগনার গ্রুপের উপস্থিতির ঘোর সমালোচক। তারা অভিযোগ করেছে, মালির মতো আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর সামরিক শাসকদের জন্য ভাগনার লাইফ ইনস্যুরেন্সের মতো কাজ করে।
চেচনার বলেন, আফ্রিকার কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার অভাব এবং সামরিক বাহিনীর আগ্রহ থেকে সেখানে ভাগনার বাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে।
চেচনার বলেন, আফ্রিকায় এই বাহিনী এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর এমন কোনো বেসরকারি বাহিনী নেই, যারা এমন দায়িত্ব পালন করতে পারে।
এই গবেষক বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কাজ করতে চায় না, আফ্রিকার এমন সরকারগুলোর সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাছে ভাগনার হচ্ছে ‘একমাত্র বিকল্প’।
তবে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ফস্টিন আর্চাঞ্জ তোয়াদেরার উপদেষ্টা ফিদেল গোয়ান্দজিকা সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় এখানে খুব একটা প্রভাব পড়বে না।
ফিদেল বলেন, ‘রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। এই কাঠামোর আওতায় রুশ ফেডারেশন সাবকন্ট্রাক্টে ভাগনার আধা সামরিক বাহিনীকে এখানে কাজ দিয়েছে।’