স্পেনে এআই দিয়ে কিশোরী–তরুণীদের নগ্ন ছবি প্রকাশ
স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি শহরে স্থানীয় কিশোরী ও তরুণীদের নগ্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় বাদাজোজ প্রদেশের আলমেন্দ্রালেজো শহরের বাসিন্দারা হতবাক হয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া সব কটি নগ্ন ছবিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অ্যাপ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
আলমেন্দ্রালেজো শহরের কিশোরী ও তরুণীদের লক্ষ্য করেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাঁদের পোশাক পরা ছবি সংগ্রহ করে এআইয়ের মাধ্যমে তা নগ্ন করে প্রকাশ করা হয়েছে। এআইযুক্ত অ্যাপ ব্যবহার করে পোশাক ছাড়াই কোনো ব্যক্তির কাল্পনিক চিত্র তৈরি করা হয়। এই কিশোরী-তরুণীদের অধিকাংশ ছবি তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২০ জনের বেশি মেয়ে এ ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এমন ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীর মা মারিয়া ব্লাঙ্কো রেয়ো বলেছেন, ‘“একদিন আমার মেয়ে স্কুল থেকে এসে জানিয়েছে, ‘মা, আমার টপলেস ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।”’
মারিয়া ব্লাঙ্কো বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে নিজের কোনো নগ্ন ছবি তুলেছে কি না। কিন্তু সে জানিয়েছে, সে এমন কোনো ছবি তোলেনি। আর এগুলো ভুয়া ছবি। এখন এমন অনেক ভুয়া ছবি তৈরি করা হচ্ছে। তার ক্লাসের আরও মেয়েদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেন, এমন ভয়াবহ ঘটনার শিকার কিশোরী-তরুণীর মা-বাবারা সংগঠিত হয়ে শহরে একটি সহায়তা গোষ্ঠী গঠন করেছে।
এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। নগ্ন ছবি তৈরি করে হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় ১১ ছেলেকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একজন তরুণীর ভুয়া ছবি তৈরি করে চাঁদা দাবি করা হয়েছিল, এমন একটি অভিযোগও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
ভুয়া নগ্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তা নানাভাবে ওই মেয়েদের প্রভাবিত করছে। মারিয়া ব্লাঙ্কো বলেন, তাঁর মেয়ে স্বাভাবিক আছে। কিন্তু অনেক মেয়েই অপমান ও লজ্জায় বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না।
আলমেন্দ্রালেজো একটি মনোরম শহর। শহরটিতে ৩০ হাজারের মতো জনসংখ্যা আছে। জলপাই ও রেড ওয়াইন উৎপাদনের জন্য শহরটি বেশ পরিচিত। নগ্ন ছবি প্রকাশের মতো ঘটনা এর আগে এ শহরে ঘটেনি।
বিষয়টি প্রথম সামনে নিয়ে আসেন মরিয়ম আল আদিব। পেশায় একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মরিয়ম বিষয়টি তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছিলেন। এরপর বিষয়টি বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে।
ধারণা করা হচ্ছে, এআই ব্যবহার করে এসব ভুয়া নগ্ন ছবি গরমকালে তৈরি করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি এ ঘটনার শিকার মেয়ে ও তাদের মা-বাবাদের আশ্বস্ত করতে মরিয়ম একটি ভিডিও পোস্ট করেন। এর পরেই তা জানাজানি হয়।
চিকিৎসক মরিয়ম আল আদিব বলেন, ‘আমরা জানি না যে ঠিক কতগুলো মেয়ের এমন ছবি তৈরি করা হয়েছে। তারা যদি নগ্ন ছবিগুলো পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটে আপলোড করত—আমাদের কেবল এই ভয় ছিল।’
মরিয়ম আরও বলেন, ‘যখন আপনি কোনো অপরাধ বা ছিনতাইয়ের শিকার হন, তখন কোনো কিছু না লুকিয়ে আপনি অভিযোগ করেন। কারণ, অন্য কেউ আপনার ক্ষতি করছে। কিন্তু যৌন অপরাধের শিকার হলেই মানুষ প্রায় সময় লজ্জাবোধ করে, লুকিয়ে থাকে এবং নিজেকে দায়ী বোধ করে। আমি মূলত এ বার্তা দিতে চেয়েছিলাম যে এটি আপনার দোষ নয়।’
এ ঘটনায় যারা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের বয়স ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে যৌনতাসংশ্লিষ্ট ছবি তৈরি করার বিষয়টি স্প্যানিশ আইনের আওতায় পড়ে না। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ হতে পারে। তবে এ ধরনের ছবি যদি অপ্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে করা হয়, তাহলে তা শিশু পর্নোগ্রাফি হিসেবে গণ্য হতে পারে। স্পেনে অপ্রাপ্তবয়স্করা ১৪ বছরের বেশি বয়স থেকে শুধু ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারে।
আলমেন্দ্রালেজো শহরে যাঁরা এ ঘটনার শিকার হননি, তাঁরাও এখন উদ্বেগের মধ্যে আছেন। ১৬ বছর বয়সী ছেলে ও ১২ বছর বয়সী কন্যাসন্তানের মা গেমা লরেনজো বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যাঁদের সন্তান আছে, তাঁরা সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছি। যদি ছেলে থাকে, তাহলে উদ্বিগ্ন যে সে হয়তো এমন কিছু করতে পারে। আর মেয়ে থাকলে তা আরও বেশি চিন্তার। কারণ, সে এই জঘন্য ঘটনার শিকার হবে।’
স্থানীয় এক চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিসকো জ্যাভিয়ের গুয়েরা বলেছেন, এ ঘটনায় জড়িত ছেলেদের মা-বাবারাও দায়ী। কারণ, তাঁদের আগে কিছু করা উচিত ছিল, যেমন সন্তানদের কাছ থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া বা মুঠোফোনে কী ইনস্টল করছে, কী কী করছে—এসব তদারকি করা উচিত ছিল।
স্পেনে এমন ঘটনা, এটাই প্রথম নয়। চলতি বছরের শুরুতে এআইয়ের মাধ্যমে সংগীতশিল্পী রোসালিয়ার টপলেস ছবি তৈরি করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছিল।
মরিয়ম আল আদিব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেও এমনটি ঘটেছে। তাঁরা কী করবেন, তা জানেন না। সারা বিশ্বে এ ঘটনা ঘটছে। অন্যান্য জায়গার থেকে এখানে পার্থক্য হলো, আলমেন্দ্রালেজোতে আমরা বিষয়টি নিয়ে হইচই করছি।’
আলমেন্দ্রালেজোতে এ ধরনের ভুয়া নগ্ন ছবি তৈরির অ্যাপগুলো ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠছে। সবার হাতের নাগালে চলে আসছে। দেশটির পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান জাভিয়ের ইজকুয়ের্দো গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এ ধরনের অপরাধগুলো আর ডার্ক ওয়েব বা ইন্টারনেটের কোনো গোপন ফোরাম থেকে শিশুদের পর্নো ডাউনলোড করেন, এমন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা এখন যে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, তা হলো এসব ঘটনার মতো অপ্রাপ্তবয়স্কদের এত কম বয়সে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া।’