যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ করলে কঠোর সাজা পেতে হবে রুশ সেনাদের
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে হোঁচট খাওয়ার পর দেশটিতে ‘আংশিক সেনা নিযুক্তির’ ঘোষণা দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে দেশটির শহরে শহরে চলছে বিক্ষোভ। প্রতিবাদী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠেছে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া যখন খানিকটা কোণঠাসা, তখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নতুন একটি আইনে সই করেছেন। আইন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনো সেনা পালালে অথবা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে কঠোর সাজার মুখে পড়তে হবে।
মস্কোর স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার নতুন ওই আইনের খসড়ায় স্বাক্ষর করেন পুতিন। এর তিন দিন আগে বুধবার সেনা নিযুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ঘোষণা অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর আপৎকালের জন্য সংরক্ষিত সেনাদের কিছু অংশকে ডাকা হবে। তা ছাড়া তিন লাখের বেশি সেনাকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
রাশিয়ার নিয়মিত সেনাদের পাশাপাশি সংরক্ষিত যেসব সেনাসদস্যকে যুদ্ধের জন্য ডাকা হচ্ছে, তাঁরাও এ নতুন আইনের আওতায় পড়বেন। আইন অনুযায়ী, কোনো সেনা যদি যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন, তাঁকে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তবে প্রথমবার এ ধরনের অপরাধের পর কেউ যদি আবার নিজ সেনাদলে ফিরে যান, আর আটক থাকার সময় অন্য কোনো অপরাধ না করেন, তাহলে তাঁদের সাজা এড়ানোর সুযোগ থাকবে।
আইনের খসড়াটি রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, সেনা সমাবেশ বা যুদ্ধের সময় কোনো সেনা পালালে তাঁর ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা হতে পারে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে কাজ না করার অধিকার রয়েছে, এমনটা কেউ দাবি করলে তাঁর সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল হতে পারে। আর সেনা সমাবেশ বা যুদ্ধের সময় কেউ লুটপাটে জড়িত থাকলে তাঁর ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
রাশিয়ার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের আইনপ্রণেতারা গত জুলাইয়ে আইনের খসড়াটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন। চলতি সপ্তাহে সেটি পার্লামেন্টে দুটি কক্ষ থেকেই অনুমোদন পায়। এরপরই রুশ প্রেসিডেন্ট সেটিতে স্বাক্ষর করে আইনে পরিণত করলেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকের ভাষ্যমতে, আংশিক সেনা সমাবেশের বিষয়টি সামনে রেখেই পার্লামেন্টে আইনটির দ্রুত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, ধরপাকড়
পুতিনের আংশিক সেনা নিযুক্তির ঘোষণার পর রাশিয়ায় যাঁদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে সক্ষম মনে করা হচ্ছে, তাঁদের বাড়িতে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। পুতিনের ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকে। এর জেরে রাশিয়ার শহরে শহরে চলছে বিক্ষোভ।
রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, দেশটিতে অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ। ফলে চলমান বিক্ষোভে ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটছে। এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। শুধু শনিবারেই ৩২টি শহর থেকে ৭৯৮ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার মানবাধিকারবিষয়ক স্বাধীন ধারার সংগঠন ওভিডি ইনফো।
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমি পুতিনের হয়ে লড়তে যুদ্ধে যেতে চাই না।’ একই মনোভাব ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ নাতালিয়া দুবোভার। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে। যেসব তরুণকে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছেন।
শনিবার আটক হওয়া ব্যক্তিদের কেউ কেউ বলেছেন, তাঁদের যুদ্ধে যোগদানের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক থাকা অবস্থাতেই তাঁদের সেনা নিয়োগ কেন্দ্রগুলোয় হাজির হতে বলা হয়েছে। তবে ক্রেমলিন বলছে, এ ধরনের তৎপরতা আইনবিরোধী নয়।
এদিকে রাশিয়া ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্তির জন্য ইউক্রেনের দখলকৃত চারটি অঞ্চলে গণভোট আয়োজন করায় সমালোচনার মুখে পড়েছে মস্কো। এ বিষয়ে শনিবার নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ায় যদি কোনো অঞ্চল যুক্ত হয়, তাহলে সেগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকার রাশিয়ার রয়েছে।
দেশ ছাড়ছেন রুশ তরুণেরা
জোর করে যুদ্ধে পাঠানোর পদক্ষেপ থেকে বাঁচতে রুশ তরুণদের অনেকে দেশ ছাড়ছেন। প্রতিবেশী দেশ জর্জিয়া সীমান্তে ৩০ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে রুশ গাড়ির সারি দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের দেশ ছেড়ে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মস্কো।
তরুণদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্থানীয় রুশ কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাষ্যমতে, অনেক গাড়ি সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। শুধু একটি ফাঁড়িতেই আড়াই হাজার গাড়ির লাইন রয়েছে। যদিও গত বৃহস্পতিবারেই তাঁরা বলেছিলেন, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর ‘ভুয়া’।
জর্জিয়ার পাশাপাশি ফিনল্যান্ডেও পাড়ি দিচ্ছেন রুশ নাগরিকেরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে ফিনল্যান্ডের সীমান্তরক্ষীদের মুখপাত্র মাত্তি পিতকানিত্তি বলেন, গত সপ্তাহে রাশিয়া থেকে ফিনল্যান্ডে আসা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।