যুদ্ধক্ষেত্রে কী ঘটছে, উঠে এল রুশ সেনার কথায়
যুদ্ধের সময় দুইবার গুলি লেগেছিল সের্গেইয়ের (ছদ্মনাম)। চিকিৎসা শেষে এই রুশ সেনাকে আবার যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেবারও কম কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। তৃষ্ণা মেটাতে তুষার পর্যন্ত গলিয়ে খেতে হয়েছিল। আর একদিন একটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ কিছু সময়ের জন্য কেড়ে নেয় তাঁর দৃষ্টিশক্তি। সেবার এক চিকিৎসক তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
আরেকজন আন্দ্রেই (ছদ্মনাম)। মাদকাসক্তির অভিযোগে ২০ বছর বয়সে তাঁর ঠাঁই হয় কারাগারে। এর তিন বছর পর সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইউক্রেন যুদ্ধে। কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। পরিণতি, তিন সপ্তাহ পর হামলায় মৃত্যু। ওই হামলায় আরও ৬০ রুশ সেনা নিহত হন। সেদিন মস্কোর রেড স্কয়ারে নাৎসিদের পরাজয় উদ্যাপন করছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
প্রথম ঘটনাটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফেরার। পরেরটি অল্প বয়সে মৃত্যুর। দুটি ঘটনাই একটি বাস্তবতা তুলে ধরছে। তা হলো যুদ্ধক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছেন রুশ সেনারা। হতাহত সেনাদের অনেকেই একসময় ছিলেন কারাবন্দী। মুক্তির বিনিময়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ‘স্ট্রম-জেড’ নামের একটি ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা।
এই কারাবন্দীরা মুক্তির আশায় লড়ছেন। তবে মুক্তি তো পরের কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁচে থাকাটাই তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রথমে তাঁদের যুদ্ধে নামিয়েছিল ভাড়াটে যুদ্ধ সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপ। পরে একই পথে হাঁটে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। যেমন স্ট্রম-জেড ব্যাটালিয়নটি এই মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে।
ইউক্রেনে দিনের পর দিন মৃত্যুর আতঙ্ক ঘাড়ে নিয়ে চলেছেন সের্গেই। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে পানি না খেয়ে থাকতে হতো। শীতের সময় তুষার গলিয়ে খেতাম।’
নিহত আন্দ্রেইয়ের মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে সিএনএনের। ছেলের সঙ্গে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তা উঠে এসেছে তাঁর কিছু ভিডিও, নথিপত্র ও খুদে বার্তা থেকে। বেঁচে ফেরা সের্গেইও এক মাস আগে সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। গত সপ্তাহেও কথা হয়েছে। জানিয়েছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের ময়দানে রুশ সেনাদের করুণ পরিণতির কথা।
আতঙ্ক নিয়ে দিনের পর দিন
সের্গেই ইউক্রেনে আট মাস যুদ্ধ করেছেন। গত শীতে তাঁর এক পায়ে গুলি লাগে। ১০ দিন চিকিৎসার পর তাঁকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর গুলি লাগে তাঁর কাঁধে। হাসপাতালে কাটে দুই মাস। তারপর ঠিকানা সেই যুদ্ধের ময়দান। সের্গেই বলেন, অঙ্গহানির শিকার একজন কারাবন্দীকে দিয়ে যুদ্ধে রেডিওর মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানের কাজ করাতে দেখেছেন তিনি। আর সেনারা তাঁদের বুলেটপ্রুফ পোশাক খুলে রাখতেন। কারণ, সেগুলো সামান্য সুরক্ষাও দিতে পারে না।
সের্গেইকে একটি হাসপাতালে চাকরি দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণ বাঁচানো সেই চিকিৎসক। পরিবারের খরচ মেটাতে তিনি আরও একটি চাকরি করেন। আশা, গুলি খাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রুশ সরকার থেকে কিছু অর্থ পাবেন। তিনি বলেন, রাতের বেলায় এখনো তাঁর কানে বাজে গোলা বিস্ফোরণের শব্দ। তাই নিজের বাড়িতেও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না তিনি।
সের্গেই যে সেনাদলে ছিলেন, তাতে প্রথমে কারাবন্দী ছিলেন ৬০০ জন। সেটা গত বছরের অক্টোবরের ঘটনা। এখন ১৭০ জন বেঁচে আছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র দুজন বাদে সবাই কমবেশি আহত হয়েছেন। সের্গেই বলেন, কেউ কেউ তো তিন-চারবার আহত হয়েছেন। একবার তাঁদের দলের কাছে আঘাত হানা একটি গোলায় অনেক সেনার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
এমন একদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সের্গেই বলেন, একদিন তাঁরা হামলা চালিয়েছিলেন। তীব্র সংঘর্ষ চলছিল। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল, যা-ই হোক না কেন, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। একপর্যায়ে একজন ইউক্রেনীয় যোদ্ধা একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। তাঁর সঙ্গে থাকা এক সেনার সারা শরীরে ওই গ্রেনেডের স্প্লিন্টার লাগে। আর তিনি প্রায় পাঁচ ঘণ্টার জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
ইউক্রেনে দিনের পর দিন মৃত্যুর আতঙ্ক ঘাড়ে নিয়ে চলেছেন সের্গেই। তাঁদের খাবার হিসেবে দেওয়া হতো, টিনের কৌটায় থাকা মাংস আর নুডলস। পানি জোগাড় করা ছিল সবচেয়ে কঠিন। সের্গেই বলেন, ‘পানি পেতে তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। অনেক সময় আমরা টানা কয়েক দিন খেতে পেতাম না। কয়েক দিন ধরে পানি না খেয়ে থাকতে হতো। শীতের সময় তুষার গলিয়ে খেতাম।’
ভেজা চোখে ইউলিয়া বলেন, ‘আমি ছেলেকে প্রতিদিন বলতাম, যুদ্ধে যেয়ো না। তবে সে আমার কথা শোনেনি।’
অনেক সময় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাঁর দলের সেনাদের হত্যার সাজা দেওয়া হতো বলে জানান সের্গেই। তিনি বলেন, ‘আমি একবার মাত্র এমনটা দেখেছি। একজন চুরি করেছিলেন, আর যুদ্ধের সময় দলের কয়েকজনকে হত্যা করেছিলেন। পরে তিনি যখন পালাতে গেলেন, পেছন থেকে তাঁর মাথায় গুলি করা হলো। এরপর তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়।’
‘কারাগার থেকে মুক্তির জন্য লড়াই’
২৩ বছর বয়সী আন্দ্রেই যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা দেখেছিলেন অল্প সময়ের জন্য, মাত্র তিন সপ্তাহ। তাঁর মা ইউলিয়া ছেলের কয়েকটি অডিও বার্তা শুনিয়েছেন। সেখানে আন্দ্রেইকে আবহাওয়া নিয়ে মজা করতে শোনা গেছে। ইউলিয়ার ভাষায়, তাঁর ছেলে তখনো একজন ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠেননি।
ইউলিয়া বলেন, ‘যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাকে (আন্দ্রেই) কত অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা তাঁর মনে ছিল না। সে অত হিসাব মিলিয়ে দেখেনি। আমি তার মধ্যে এই অর্থ পাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখিনি। সে যেটা চেয়েছিল, তা ছিল মুক্তি। তার অনেক বছরের সাজা হয়েছিল (মাদক-সংক্রান্ত অভিযোগে) সাড়ে ৯ বছর। আর সে মাত্র তিন বছর সাজা খেটেছিল।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিও রয়েছে ইউলিয়ার কাছে। সেখানে আন্দ্রেইকে যুদ্ধে হামলার প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে। আর কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে, আন্দ্রেইয়ের রোদে পুড়ে যাওয়া বিবর্ণ চেহারা। কোনোমতে কামানো দাড়ি। মাথায় বড় একটি হেলমেট পরে গাড়ির পেছনে বসে ছিলেন তিনি। তবে এমন ছবি বেশি নেই ইউলিয়ার কাছে। কারণ, যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মাথায় মৃত্যু হয় তাঁর ছেলের।
গত মে মাসে মায়ের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন আন্দ্রেই। বলেছিলেন, পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারিতে পাঠানো হচ্ছে তাঁদের। পরদিন সন্ধ্যায় হামলা শুরু করবেন তাঁরা। মস্কোয় সেদিন বিশাল আয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজিত করার বর্ষপূতি উপলক্ষে রেড স্কয়ারজুড়ে চলবে কুচকাওয়াজ। এই আয়োজনের মূল কেন্দ্রে ছিলেন পুতিন।
সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে ভিজে যায় মায়ের চোখ। ইউলিয়া বলেন, ‘আমরা ঝগড়া শুরু করেছিলাম। বলতে খারাপ শোনায়, তবে আমার মনে হচ্ছিল, ও আর বাঁচবে না। সবকিছু জেনেই সে রাশিয়া ছেড়েছিল। আমি প্রতিদিন বলতাম, যেয়ো না। তবে সে আমার কথা শোনেনি।’
তারপর রুশ সেনাবাহিনীর ওই দলের অনেকের মতোই আন্দ্রেই একেবারে হারিয়ে গিয়েছিলেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর ইউলিয়া জানতে পারেন, তাঁর ছেলে যে দলে ছিলেন, ওই দলের অন্তত ৬০ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে। একই পরিণতি হয়েছে আন্দ্রেইয়েরও।
ইউলিয়া ছেলের লাশ পাননি। এমনকি আন্দ্রেইয়ের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রও তাঁকে দেওয়া হয়নি। এসেছিল শুধু একটি চিঠি। আন্দ্রেইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে ওই চিঠি পাঠিয়েছিল রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। চোখে জল নিয়ে ইউলিয়া বললেন, ‘আমার ভয় হতো, ও আমার কাছে একজন খুনি হিসেবে ফিরে আসবে। মাদকাসক্ত হিসেবে আমার ছেলেকে মেনে নিতে পারতাম। তবে একজন খুনি হিসেবে তাকে মেনে নেওয়া আমার জন্য কঠিন হতো।’