বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সীমাবদ্ধতা আবার সামনে এল
পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর প্রশ্ন উঠেছে মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনে একই ধরনের অপরাধের অভিযোগ থাকলেও আইসিসি কেন কিছু করেনি।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি ভেটো ক্ষমতার অধিকারীর অন্যতম রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা আদালতটির কর্তৃত্ব প্রয়োগের এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই পরোয়ানাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ করেছেন। অন্যদিকে রাশিয়া এই পরোয়ানা দেশটির কাছে অর্থহীন বলে অভিহিত করেছে।
এই পরোয়ানা জারির পর অনেকে এখন আশাবাদ প্রকাশ করেছেন, একই অপরাধে অভিযুক্ত মিয়ানমারের সেনাশাসকসহ অন্য অভিযুক্তদের বিচার হবে। আইসিসির প্রতি তাঁরা অচিরেই একই পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনে একই ধরনের অপরাধের অভিযোগ আছে যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের বেলায় আইসিসি কেন কিছু করেনি?
বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় শক্তিধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো বাকি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের জন্য একটা শক্তিশালী বার্তা হবে বলে আদালতের আদেশে ইঙ্গিত রয়েছে।
তবে আদালত আসলে দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন কি না, সে প্রশ্ন আদালতটির ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ককে জোরদার করবে। সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা এ প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ইয়াং হি লি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক শাসক জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের জন্য এখনো কেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো না। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার সংগঠকেরা।
স্মরণ করা যেতে পারে, জাতিসংঘের একটি তদন্তকারী দল তাদের তদন্ত সম্পন্ন করে গণহত্যার উদ্দেশ্যে জাতিগত নির্মূলের প্রমাণ পাওয়ার কথা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এখন সেসব সাক্ষ্য ও আলামত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের একটি নতুন ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর ২০১৯ সাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। কৌঁসুলি করিম খানও গত বছর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দেখতে গেছেন।
আইসিসি এর আগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আরও দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। দুজনই আফ্রিকার দুটি দেশের সরকারপ্রধান ছিলেন। একজন হলেন সুদানের ওমর আল বাশার এবং অপরজন লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফি।
রোম সনদের আলোচনার সময়েই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোশেভিচের আর আইসিসি প্রতিষ্ঠার পরও ২০১২ সালে আফ্রিকায় একটি বিশেষ আদালত করে বিচার করা হয় লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরের।
কিন্তু তারপর ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের সামরিক জোটের সদস্যদেশগুলোর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগ উঠেছে। ওই সব দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থায় অনেক সেনাসদস্যের বিচারও হয়েছে। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ইরাকে অভিযান পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আইসিসি কর্ণপাত করেনি।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনী ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে এবং তালেবানের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের জন্য আইসিসি সিদ্ধান্ত নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও হুমকির মুখে তা আর এগোয়নি। ২০২০ সালের ৫ মার্চ আইসিসির প্রাক্-বিচারিক ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত পরিচালনার যৌক্তিক কারণ রয়েছে ঘোষণা করে ওই তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
তখন যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির বিরুদ্ধে নানা আইনগত ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ঘোষণা করে। ২০২০ সালের ১১ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে আইসিসির বিচারক ও কৌঁসুলিদের যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক লেনদেন ও ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ওই আদেশে আফগানিস্তান ছাড়াও বিশ্বের অন্য কোথাও মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমোদন ছাড়া তদন্ত করার চেষ্টা হলে তার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা ছিল।
আইসিসির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু তাদের নিজেদের সৈন্যদের ক্ষেত্রেই সীমিত রাখেনি, তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রেও একই ভূমিকা নেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলিদের অপরাধের বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে যে সে রকম কোনো তদন্ত হলে তার পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতিসংঘের একটি তদন্ত দলকে ইসরায়েল সেখানে ঢুকতে না দিলেও তারা বিষয়টিতে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন মানবাধিকার পরিষদে পেশ করেছে। কিন্তু আইসিসিতে আর অগ্রগতি নেই।
২০২০ সালের ২৫ জুন জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ ‘বিচারিক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি’ বলে অভিহিত করেন।
যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার মতো অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই জাতিসংঘের আয়োজনে এক সম্মেলনে রোম সনদ অনুমোদিত হওয়ার মাধ্যমে আইসিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দেশের অনুসমর্থনের পর ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে সনদটি কার্যকর হয়েছে। ১২৩টি দেশ সনদটি অনুমোদন করলেও রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি বৃহৎ ও উদীয়মান শক্তি তাতে অনুসমর্থন দেয়নি। আইসিসি কিংবা জাতিসংঘের যেহেতু নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই, তাই সনদের বিধান হচ্ছে, সদস্যদেশগুলো আদালতের অনুরোধ ও আদেশ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে দায়বদ্ধ থাকবে।
সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের ক্ষেত্রে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আরব লিগ আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সমর্থন করেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ একাধিক দেশ আইসিসির পরোয়ানা কার্যকর করেনি এবং তিনি কয়েকটি দেশে নির্বিঘ্ন সফর করেছেন। তবে ১৯৮৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে ওমর বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০২০ সালে সুদানের নতুন সরকার তাঁকে আইসিসিতে বিচারের জন্য পাঠাতে রাজি হয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষেত্রেও তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে সনদে অংশগ্রহণকারী ১২৩টি দেশে তাঁর সফর যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল, তেমনি ওই সব দেশের জন্যও তা এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল।
আইসিসি যাঁকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করতে চায়, তেমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রাখাও এখন এসব দেশের সরকারগুলোর জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনে আগ্রাসনের সমর্থকেরা এখন আইসিসির পরোয়ানাকে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার আরেকটি প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় সফল না হওয়ায় আদালতকে এখন হাতিয়ার করা হচ্ছে।
স্পষ্টতই এ বিতর্ক আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে দিয়েছে। এটি এমন সীমাবদ্ধতা, যা থেকে উত্তরণ না ঘটলে বিশ্বে আগ্রাসন, জাতিগত নিপীড়ন ও গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে।
‘জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলোয় যেকোনো রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি বা শক্তির ব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য সব রাষ্ট্রের নিবৃত্ত থাকার’ যে অঙ্গীকার রয়েছে, রোম সনদের প্রস্তাবনায় তা পুনর্ব্যক্ত করার কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তিধর রাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় এবং সাহসী কাজ। কিন্তু নীতিটি সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে না পারার ব্যর্থতার দরুন সৃষ্ট বিতর্ক এড়ানো তো সহজ নয়।