ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করছে রাশিয়া

রুশদের হাতে নিহত ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দী আলেকসান্দার মাতসিভস্কি। রাশিয়ার সেনারা গুলি করে হত্যা করার অল্প সময় আগেছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর প্রথম বছরেই রুশ সেনাদের কাছে ধরা পড়েন ইউক্রেনের স্নাইপার আলেকসান্দার মাতসিভস্কি। পরবর্তী সময়ে তাঁকে একটি ভিডিওতে দেখা যায়। তাতে একটি বনের মধ্যে সম্ভবত নিজের শেষ সিগারেট ফুঁকছিলেন তিনি। ভিডিও দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁকে দিয়েই জোর করে খনন করা একটি গর্তের পাশে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে।

তাঁকে বন্দী করা লোকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন মহিমান্বিত হোক’। এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তাঁর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

আলেকসান্দার মাতসিভস্কির মতো আরও অনেক যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করেছেন রুশ সেনারা।

চলতি বছরের অক্টোবরে কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের ৯ জন বন্দী সেনাকে রুশ সেনারা গুলি করে হত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। ইউক্রেনের কৌঁসুলিরা ঘটনাটি তদন্ত করছেন। মাটিতে শায়িত অর্ধনগ্ন কিছু মরদেহের একটি ছবি ধরে তাঁদের তদন্ত এগোচ্ছে। এই ছবি থেকে ড্রোন পরিচালনাকারী রুসলান হোলুবেনকোর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। রুসলানের মা-বাবা তাঁকে শনাক্ত করেছেন।

স্থানীয় সম্প্রচারমাধ্যম সাসপিলনে চেরনিহিভকে তাঁর মা বলেছেন, ‘রুসলানের অন্তর্বাস দেখে আমি তাঁকে শনাক্ত করেছি। একবার সাগরে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমি তাঁর জন্য এটি কিনেছিলাম। তাঁর কাঁধে গুলি করা হয়েছিল বলে আমি জানতে পেরেছি। আপনি ছবিতে এটা দেখতে পাবেন।’

রুশ সেনাদের হাতে ইউক্রেনীয় সেনাদের মৃত্যুদণ্ডের তালিকা বেড়েই চলছে। ইউক্রেনের কৌঁসুলিরা কয়েকটি শিরশ্ছেদের প্রতিবেদন তদন্ত করে দেখছেন। দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ইউক্রেনের এক সেনাকে হত্যা করা হয়েছিল এমন একটি তলোয়ার তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে বিনিময়ের পর ইউক্রেনের কয়েকজন যুদ্ধবন্দী। ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে, ২৪ নভেম্বর ২০২২
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উদাহরণ হিসেবে আরেকটি ভিডিওর কথা বলা যায়, যেখানে ইউক্রেনের ১৬ সেনাকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় এবং স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলিতে তাঁদের মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করা হয়। গাছের আড়াল থেকে তাঁরা আত্মসমর্পণ করার জন্য বের হয়েছিলেন।

কিছু হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য রাশিয়ার সেনারা ভিডিও করেছিলেন আর কিছু মৃত্যুদণ্ডের দৃশ্য ধারণ ইউক্রেনের ড্রোন ব্যবহার করে ধারণ করা হয়েছে।

এসব ভিডিওতে যেসব হত্যাকাণ্ড ধারণ করা হয়েছে, তা সাধারণত বনবাদাড় বা বিশেষ কোনো মাঠে সংগঠিত হয়েছে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে এসব জায়গা সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত করা কঠিন। তবে বিবিসি একটি শিরশ্ছেদসহ বেশ কিছু ঘটনা যাচাই করে নিশ্চিত করতে পেরেছে, যেখানে ভুক্তভোগীরা ইউক্রেনের উর্দি পরা ছিলেন। ভিডিওগুলো নতুন।

সংখ্যা বাড়ছে

ইউক্রেনিয়ান প্রসিকিউটর-জেনারেলস অফিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের অন্তত ১৪৭ যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করেছে রুশ বাহিনী। এর মধ্যে চলতি বছরই হত্যা করা হয়েছে ১২৭ জনকে।

ইউক্রেনের প্রসিকিউটর-জেনারেলস অফিসের যুদ্ধ বিভাগের প্রধান ইউরি বেলোসভ বলেন, ‘হত্যার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বেশ পরিষ্কার, খুব স্পষ্ট।’

ইউক্রেনের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বর থেকে পদ্ধতিগতভাবে যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা হচ্ছে এবং এই বছরের পুরো সময়ে তা চলেছে। দুঃখজনকভাবে এই গ্রীষ্ম ও শরতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। এর অর্থ হলো, এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এসব ঘটছে এবং এসব যে একটি নীতির অংশ, তা স্পষ্ট। এসব কিছু কার্যকরের জন্য যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার প্রমাণ রয়েছে।’

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, বিশেষত তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দীদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই তাঁদের হত্যা করাটা যুদ্ধাপরাধ।

এসব সত্ত্বেও রুশ রিপাবলিক অব চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী তাঁর কমান্ডারদের ‘কোনো যুদ্ধবন্দী না নিতে’ নির্দেশ দিয়েছেন।

রাশিয়ার বন্দীদশা থেকে ফেরার পর ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দীদের উচ্ছ্বাস। ইউক্রেনের একটি অজ্ঞাত স্থানে, ৩১ মে ২০২৪
ছবি: রয়টার্স

দায়মুক্তি

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর রাচেল ডেনবার বলেন, রাশিয়ার সেনাদের ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দীদের হত্যার করার অভিযোগ সমর্থন করার মতো প্রমাণের অভাব নেই।

এই নারী মানবাধিকার কর্মকর্তার মতে, এসব যুদ্ধবন্দী হত্যার পেছনে দায়মুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে কিছু গুরুতর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

রাচেল জানতে চান, ‘এসব ইউনিটের কাছে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের কমান্ডারদের কাছ থেকে কী নির্দেশনা ছিল? জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণের কথা বলা হয়েছে, তাঁদের কমান্ডারদের কাছে তা কি সম্পূর্ণ পরিষ্কার? তাঁদের ইউনিটকে তাঁদের আচরণ সম্পর্কে রাশিয়ার কমান্ডাররা কী বলছেন? এসব ঘটনা তদন্ত করতে চেইন অব কমান্ড কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে? ’

যত দূর জানা যায়, নিজেদের বাহিনীর হাতে ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দীদের হত্যাকাণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করতে রাশিয়া উদ্যোগ নিয়েছে এমন কিছু জানা যায় না।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতে, ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রুশ সেনারা ‘সব সময় আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইনি নথি কড়াকড়িভাবে মেনে চলেন’।

ইউক্রেনের বাহিনীর বিরুদ্ধেও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দীদের হত্যার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এই সংখ্যা অনেক কম।