আল–জাজিরার বিশ্লেষণ
রাশিয়া–ইউক্রেন যু্দ্ধ: যুক্তরাষ্ট্রের পালে হাওয়া না দিয়ে নিজেদের স্বার্থ দেখছে সৌদি আরব
ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ আট মাস শেষ হয়েছে। শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেক দেশই আবার ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিম বা রাশিয়া—কোনো পক্ষকেই সরাসরি সমর্থন জানায়নি। তাদের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবসহ গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্য দেশগুলো।
জিসিসি সদস্যদের দৃষ্টিতে, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয়দের। এর হিসাবনিকাশও জটিল। তাই তাদের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো দরকার নেই। মোদ্দাকথা, দলাদলি করতে গিয়ে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের কোনো সাধ নেই তাদের।
ইউক্রেন যুদ্ধ যখন নবম মাসে প্রবেশ করেছে, তখন বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেছেন, ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পশ্চিমাদের চাপ এখনো গায়ে মাখবে না সৌদি আরব। এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতার কথা বলে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছেন রিয়াদের নেতারা। নিজেদের অবস্থানের মাধ্যমে তাঁরা এটাও বোঝাতে চাইছেন, ওয়াশিংটনের ছড়ির ইশারায় চলেন না তাঁরা।
এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পক্ষেও আরবরা সরাসরি যায়নি। সমর্থন দেয়নি ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে অঙ্গীভূত করাকে। ইউক্রেনে হামলার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিয়েছে তারা। তবে পশ্চিমাদের দেখানো পথে মস্কোর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়নি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরব গালফ স্টেট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ হুসেইন ইবিশ চলতি মাসেই বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পটপরিবর্তনের মুহূর্ত হিসেবে পশ্চিমারা যেভাবে দেখছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো সেভাবে দেখছে না।
ইউক্রেন যুদ্ধ যখন নবম মাসে প্রবেশ করেছে, তখন বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পশ্চিমাদের চাপ এখনো গায়ে মাখবে না সৌদি আরব। এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতার কথা বলে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছেন রিয়াদের নেতারা। নিজেদের অবস্থানের মাধ্যমে তাঁরা এটাও বোঝাতে চাইছেন, ওয়াশিংটনের ছড়ির ইশারায় চলেন না তাঁরা।
সৌদি আরব বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর পাল্লাপাল্লির ফাঁদে পড়তে চাইছে না বলে মন্তব্য করেছেন ইয়েমেনে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফেইয়ারস্টেইন। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, সৌদি আরবের নেতারা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট করেছেন। তাঁরা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীন এবং শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের জোট ওপেক প্লাসের প্রধান অংশীদার রাশিয়া—সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার ওপর নজর দিচ্ছে।
সৌদি–রাশিয়া সম্পর্ক
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর পরও রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছে সৌদি আরব। এমনকি যুদ্ধের শুরুর দিকে রাশিয়ার জ্বালানিপ্রতিষ্ঠান গাজপ্রম, রসনেফ্ট ও লুকোইলে কমপক্ষে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে দেশটি। ঠিক ওই সময়েই রাশিয়ার জ্বালানিপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছিল পশ্চিমারা।
সম্পর্কের এই ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়েও। ৫ অক্টোবর সৌদি আরব ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে রিয়াদ। এতে দেশটির অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে।
রাশিয়ার সঙ্গে নানা খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও ইউক্রেনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে সৌদি আরব। গত সেপ্টেম্বরে তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে বন্দিবিনিময় হয়। ওই বন্দিবিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ কয়েকজন নাগরিক রাশিয়ার হাত থেকে মুক্তি পান। ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে আটক হন তাঁরা। এই বন্দীদের মধ্যে দুজন মার্কিন নাগরিকও ছিলেন। ফলে সৌদি আরবের মধ্যস্থতার সুবিধা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপও।
তবে ওপেক প্লাসের ওই ঘোষণায় চটেছেন ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা মনে করেন, ওপেক প্লাসের ঘোষণা পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাশিয়াকে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে সহায়তা করবে এবং এটি পুতিন সরকারকে একঘরে করার তাদের যে প্রচেষ্টা তার ক্ষতি করবে।
রিয়াদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিং ফয়সাল সেন্টারের গবেষক জোসেফ এ কেচিচিয়ান আল–জাজিরাকে বলেন, ২০২২ সালে বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের আশপাশে রাখতে মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন সৌদি আরবের নেতারা। কারণ, দেশটিতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগের জন্য তাঁদের অর্থের দরকার। আর এটা শুধু সম্ভব ছিল ওপেক প্লাসের দেশগুলোর মধ্যে মধ্যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতেও মস্কোর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের এই সম্পর্ক বজায় থাকলে তা রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে। সৌদি আরবের সঙ্গে পড়তির দিকে থাকা প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন মাকিন আইনপ্রণেতারা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘নোপেক’ আইনের প্রতিও সমর্থন দিয়েছেন তাঁরা। এতে করে বোঝা যায়, চলতি বছরে ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফেইয়ারস্টেইনের ভাষায়, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা যে কোনো একটি পক্ষ নিতে রিয়াদকে চাপের মুখে ফেলেছে। তবে তারা সেটা করতে চাচ্ছে না। সম্প্রতি ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা এই বাস্তবতাই সামনে এনেছে যে সৌদি আরব যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে বিষয়টি এভাবে দেখা হবে: ‘তোমরা কি আমাদের সঙ্গে আছ, না কি বিপক্ষে?’
ইউক্রেনকে সহায়তা
রাশিয়ার সঙ্গে নানা খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও ইউক্রেনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে সৌদি আরব। গত সেপ্টেম্বরে তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যস্ততায় মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে বন্দিবিনিময় হয়। ওই বন্দিবিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ কয়েকজন নাগরিক রাশিয়া হাত থেকে মুক্তি পান। ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে আটক হন তাঁরা। ওই বন্দীদের মধ্যে দুজন মার্কিন নাগরিকও ছিলেন। ফলে সৌদি আরবের মধ্যস্থতার সুবিধা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
এদিকে গত মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সেখানে তিনি ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমাদের চোখে ভালো হতে চাচ্ছে রিয়াদ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আরব সেন্টারের গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক ইমাদ হার্ব বলেন, রিয়াদ সব সময় বলে আসছে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তবে রাশিয়ার অভিযানের সরাসরি নিন্দা জানায়নি তারা। যদিও সালমানের সহায়তার ঘোষণা ইউক্রেনের জন্য ইতিবাচক। তারপরও তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রোষানল থেকে বের হওয়া সৌদি আরবের জন্য কঠিন হবে।