ইতালির পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শেষ হয়েছে। আগামীকাল রোববার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কারণ, জনমত জরিপ অনুযায়ী এই নির্বাচনে জয় পেতে পারে ডানপন্থীরা। তাঁদের বিজয়ে দেশটি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে কি না, এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা।
ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ সালে চতুর্থ মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই সময় পুতিনকে অভিনন্দন জানাতে ইতালির কয়েকজন ডানপন্থী নেতাকে রীতিমতো তাড়াহুড়া করতে দেখা যায়। ব্রাদার্স অব ইতালি দলের প্রধান জর্জিয়া মেলোনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘রাশিয়ার এই নির্বাচন জনগণের ইচ্ছার দ্ব্যর্থহীন প্রতিফলন।’
মেলোনির সেই মন্তব্য সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফের সামনে এসেছে। কারণ, মারিও দ্রাঘির সরকার ভেঙে যাওয়ার পর আগামীকাল দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর এই নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে মেলোনি ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেতে পারে মেলোনির নেতৃত্বাধীন ব্রাদার্স অব ইতালি। মাত্তেও সালভিনির লিগ এবং সিলভিও বেরলুসকোনির ফোরজা ইতালিয়াকে নিয়ে ডানপন্থী সরকার গঠন করতে পারে দলটি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধে সামর্থ্যের সবকিছুই করে যাচ্ছে ইউরোপ। ঠিক সেই সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন দলগুলোর সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা রোম মস্কোর ঘনিষ্ঠ হতে পারে এমন আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজের (আইএসপিআই) রাশিয়াবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান আলদো ফেরারি বলেন, এটি একটি যৌক্তিক বিতর্ক। কিন্তু (মস্কোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের) গুরুত্ব অনুপাতে বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নির্বাচনী প্রচারণায় বিষয়টি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণে দ্বিধা করছেন না মেলোনির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্য-বাম ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা এনরিকো লেত্তা। ‘ইতালি ইউরোপের কেন্দ্রে থাকবে’—সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়া একজন প্রার্থী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন তিনি।
লেত্তা বলেন, ‘জর্জিয়া মেলোনি জয় পেলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাঁরা খুশি হবেন, তাঁরা হলেন—ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউরোপের ভিক্টর অরবান।’ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি এসব কথা বলেছেন।
রাশিয়ার ‘বড় ধরনের এই যুদ্ধের’ নিন্দা জানিয়ে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে উদ্বেগ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন মেলোনি। গত মাসে দলীয় সদর দপ্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতালির অবস্থান এবং ইউক্রেনের জনগণের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের প্রতি আমাদের সর্বাত্মক সমর্থনের বিষয়ে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা ছাড়াই গ্যারান্টর হব।’
আইএসপিআইয়ের ফেরারির মতে, মেলোনি ইউক্রেনের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট রেখেছেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাঁর উদ্বেগের বিষয়টিও বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, মেলোনির এই অবস্থানের সম্ভবত কোনো পরিবর্তন আমি দেখছি না।
প্রচারণায় ভুয়া তথ্য
নির্বাচনী প্রচারণায় বিদেশি কোনো পক্ষ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতে পারে বলে চাউর হয়েছে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংসদীয় কমিটি রাশিয়ার দিক থেকে ভুয়া তথ্য ছড়ানো, সাইবার হামলা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ আসার সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কমিটি বলছে, ‘ইউরোপের আটলান্টিসিজম ভেঙে দিতে ইতালির ব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
কমিটির তৈরি এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ইউক্রেন সংঘাতের পাশাপাশি একটি ‘কম তীব্রতার যুদ্ধ’ চলছে। সেটি হলো সাইবার স্পেসে একটি হাইব্রিড যুদ্ধ, যা আমাদের ডিজিটাল সিস্টেমকে রক্ষার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণকে সমর্থন করে।
দাপ্তরিক নির্বাচনী প্রচারণায় সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেছে ব্রাদার্স অব ইতালি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলটির সমর্থকেরা যে মতাদর্শের কথা ছড়াচ্ছেন তা প্রায়শই ‘উগ্র ডানপন্থী’ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যায়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনীতিকদের প্রতি গভীর অনাস্থা, বামপন্থী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জুজু এবং বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো বিষয়গুলো।
ইউনিভার্সিটি অব উরবিনোর ‘ম্যাপিং ইতালিয়ান নিউজ’ গবেষণা কর্মসূচির প্রধান ফ্যাবিও গিগলিয়েত্তো বলেন, ‘তাঁরা নিজেদের যেভাবেই উপস্থাপন করুক না কেন, এই আহ্বানগুলো তাঁদের মতাদর্শ দলটির মধ্যপন্থী শাখার পরিবর্তে চরম ডানপন্থীদের বলেই নির্দেশ করে।’
ধোঁয়াশার অতীত
ক্রেমলিন থেকে অবৈধভাবে তহবিল নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর মেলোনির মিত্ররা আলোচনায় এসেছে। সালভিনির একজন সহযোগীর মস্কোয় গোপন তেল চুক্তির আলাপ নিয়ে ২০১৯ সালে একটি অডিও ফাঁস হয়। তবে অন্যায় কিছু করার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
বেরলুসকোনির ওপর থাকা সরকারি দায়িত্ব গ্রহণের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তাঁকে ফের দৃশ্যপটে দেখা যেতে পারে। তাঁকে পুতিনের বন্ধু মনে করা হয়। দুজন একে অপরের অবকাশযাপনের বাড়িতে থেকেছেন।
জুলাইতে দ্রাঘি সরকারের বিদায়ের পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইগি দি মাইও অভিযোগ করেছেন, রুশ নেতৃত্ব ‘ইতালি ও ইউরোপকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে’।
ইতালির পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রাঘির জোট সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে সালভিনির লিগ এবং বেরলুসকোনির ফোরজা ইতালিয়া রুশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই সরকার ভেঙে যায়। এ ঘটনায় ক্রেমলিন ইতালির রাজনীতিতে নাক গলাতে পারে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে অন্যায় কিছু করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দুজনই।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ১২টি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩০ কোটি ডলার দিয়েছে রাশিয়া। এ নিয়ে ইতালির নির্বাচনী প্রচারণায় ঝড় উঠে। ডানপন্থী দলগুলো গোপনে কোনো ধরনের নগদ অর্থ নেওয়ার বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গেই অস্বীকার করেন।
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংসদীয় কমিটির প্রধান ব্রাদার্স অব ইতালির জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক অ্যাডলফো উরসো। তিনি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন, অর্থ গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ইতালিও আছে—এমন কোনো ইঙ্গিত ‘এই মুহূর্তে’ নেই।
আইএসপিআইয়ের ফেরারির মতে, দ্রাঘির পতন ‘নিঃসন্দেহে স্বাগত জানিয়েছে’ রাশিয়া।
জাতীয় সার্বভৌমত্বসহ বিভিন্ন অবস্থানের বিষয়ে অতীতে রাশিয়াকে মিত্র হিসেবে পেয়েছে ডানপন্থী দলগুলো। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক আবহ লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন। ফেরারি বলেন, ইউক্রেনে হামলা মস্কোর প্রতি ঝুঁকে পড়াটা অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।