পশ্চিমাদের কোন অস্ত্র কীভাবে কাজে লাগাচ্ছে ইউক্রেন
ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর বছরখানেক পেরিয়েছে। তবে এই সময়ে দুই পক্ষের কেউই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি। কখনো রুশ বাহিনী হামলা জোরদার করেছে, কখনো ইউক্রেনের বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে পাল্টা আক্রমণ জোরদার করেছে ইউক্রেনের সেনারা। রুশ অধিকৃত অঞ্চলগুলো ফিরিয়ে নিতে চায় কিয়েভ।
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ জোরালো হওয়া ও বড় পরিসরে আক্রমণের প্রস্তুতির মুখে চলমান যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, এমনটাই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। এতে রসদ জোগাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে অর্থ–অস্ত্র সরবরাহ করছে। এই তালিকায় রয়েছে যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্রের জোরে বলীয়ান ইউক্রেনের বাহিনী রাশিয়ার বিরুদ্ধে জোরালো লড়াইয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। অধিকৃত অঞ্চল পুনর্দখলের লক্ষ্য ঠিক করেছে। দেখে নেওয়া যাক ইউক্রেনের অস্ত্রভান্ডারের এখনকার অত্যাধুনিক সব সংগ্রহ—
সাঁজোয়া বহর
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ২৩০টির বেশি ট্যাংক দিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আব্রামস এম১এস এবং যুক্তরাজ্যের চ্যালেঞ্জার ২এস ট্যাংক রয়েছে। তবে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রশাসন সবচেয়ে বেশি পেয়েছে জার্মানির তৈরি অত্যাধুনিক লেপার্ড–২ ট্যাংক।
এসব ট্যাংককে ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা ভাবা হয়। এসব ট্যাংক রুশ বাহিনীর শক্তিশালী যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে রুখে দিতে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। বিশেষত অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকস ও সেন্সরব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছে। এসব ট্যাংককে রাতেও যুদ্ধ করার জন্য সক্ষম করে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
সেনাদের গতিশীলতা
সম্মুখযুদ্ধের অগ্রভাগে যদি ট্যাংকবহর থাকে, তাহলে এর পেছনেই থাকবে সেনাদের সাঁজোয়া যান। এ জন্য পশ্চিমা মিত্রদের কাছ ইউক্রেন পেয়েছে মার্কিন ব্র্যাডলি ও জার্মানির তৈরি মার্ডারের মতো অত্যাধুনিক এবং দ্রুতগতির সাঁজোয়া যান।
ট্যাংকবহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারে এসব যুদ্ধযান। বিপুলসংখ্যক সেনা পরিবহন করতে পারে। এসব যুদ্ধযানে রয়েছে ৩০ মিলিমিটারের কামান। ট্যাংক ধ্বংস করার ক্ষেপণাস্ত্র বহন ও নিক্ষেপ করার সুবিধা রয়েছে এতে। এ ছাড়া রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে শাণ দিতে ইউক্রেনকে শত শত আইএফভি দিয়েছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যরা। এখন পর্যন্ত যুদ্ধে এসব আইএফভি ইউক্রেনকে বেশ সুবিধা এনে দিয়েছে।
শুধু অস্ত্র সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয়নি, যুদ্ধক্ষেত্রে এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেই বিষয়ে ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে ন্যাটো। বিশেষ করে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে তুলনামূলক সমতল ভূমিতে যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে যে ‘গতি’ একটি কার্যকর চাবিকাঠি, সেই বিষয়ে ইউক্রেনের সেনাদের দক্ষ করা হয়েছে।
যুদ্ধে কৌশলগত সাফল্য অর্জনের জন্য দুই পক্ষই বিপুল পরিমাণে ১৫৫ মিলিমিটারের গোলাবারুদ মজুত করেছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের বাহিনী জানিয়েছে, যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে তাদের প্রতিদিন অন্তত ১২ হাজার শেল বা গোলা প্রয়োজন। অত্যাধুনিক হাউইৎজার ব্যবস্থা এসব গোলা ৩০ কিলোমিটারের বেশি দূরের লক্ষ্যে ছুড়তে সক্ষম।
হিমার্স ও দূরপাল্লার আর্টিলারি
ইউক্রেন যুদ্ধে খুবই কার্যকর একটি অস্ত্র বিবেচনা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (ব্যবস্থা) তথা হিমার্স। গাড়িতে স্থাপন করা উচ্চ প্রযুক্তির হালকা রকেট লঞ্চার হলো হিমার্স। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এটি সহজে মোতায়েন করা যায়। প্রতিটি ইউনিটে ছয়টি করে জিপিএস গাইডেড রকেট থাকে। প্রায় এক মিনিটের মধ্যে অল্প কয়েকজন মিলেই আবার রকেট লোড করে ফেলতে পারে। অত্যাধুনিক এই রকেটগুলোর পাল্লা ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল)।
নিজেদের বাহিনীতে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহের জন্য রাশিয়া অনেকাংশে রেলপথের ওপর নির্ভর করে। রেলপথ ও ডিপো স্থানান্তর করা যায় না। তাই, সহজেই এসব স্থাপনা ও বাহনকে লক্ষ্য বানানো যায়। হিমার্স ব্যবহার করে রাশিয়ার জ্বালানি ও গোলাবারুদ ডিপো ও সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে অনেক জায়গায় সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনের সেনারা।
স্ট্রম শ্যাডো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র
যুক্তরাজ্য সরকার সম্প্রতি ইউক্রেনকে শত শত স্ট্রম শ্যাডো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার কৌশলকে জটিল চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারে। খুব নিচে দিয়ে দ্রুতগতিতে লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। ২৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে উড়ে গিয়ে নির্ভুলভাবে ৪৮০ কেজির বেশি বিস্ফোরক (বাংকার ব্লাস্টার) ফেলতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি রাডারকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম।
আকাশশক্তি
যুদ্ধক্ষেত্রের আকাশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ইউক্রেনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই এগিয়ে দেবে, এমনটা ধারণা সমরবিদদের। আর এ জন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। জেলেনস্কি শুরু থেকেই পশ্চিমা মিত্রদের কাছে সহায়তা হিসেবে যুদ্ধবিমান চাচ্ছেন।
পোল্যান্ড–স্লোভাকিয়াসহ কয়েকটি মিত্রদেশ ইউক্রেনকে সোভিয়েত আমলে নির্মিত মিগ–২৯ যুদ্ধবিমান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এসব চালানের পুরোটা এখনো হাতে পায়নি কিয়েভ প্রশাসন।
যুদ্ধের শুরুর দিকে রুশ বিমানবহরের আকার ইউক্রেনের চেয়ে চার গুণের বেশি বড় ছিল। বাড়তি এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিমানবহরকে কেন গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি, সমরবিদদের কাছে এটা একটা বিস্ময়। চরম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইউক্রেনের বিমান সেনারা যুদ্ধে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সফলতাও অর্জন করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি ড্রোন সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং এটা দুই পক্ষেই। ভবিষ্যতে ভয়াবহ হামলা চালাতে ড্রোনের কার্যকর ব্যবহার যেকোনো পক্ষকে এগিয়ে দিতে পারে।
সেনাদের প্রশিক্ষণ
পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে শুধু অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র পেলেই চলবে না। সেসব অস্ত্র চালানোও শিখতে হবে। তা না হলে আধুনিক এসব অস্ত্র যুদ্ধ জয়ে কাজে আসবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধানও করে দিচ্ছে পশ্চিমারা। তারা ইউক্রেনের সেনাদের আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ জোরদার করতে ইউক্রেনের সেনা কর্মকর্তা, নন-কমিশন্ড কর্মকর্তা ও সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই প্রশিক্ষণে আকাশ প্রতিরক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দৃশ্যমান সফলতাও মিলেছে। ইতিমধ্যেই রাজধানী কিয়েভকে উপর্যুপরি রুশ হামলা থেকে রক্ষা করতে পেরেছে ইউক্রেনের বাহিনী। কিয়েভের দিকে ছুটে আসা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।