কার্চ সেতু: পুতিনের অবকাঠামো উন্নয়নের ‘রাজমুকুটের কোহিনূর’
কার্চ সেতুতে বিস্ফোরণের ঘটনা রাশিয়ার জন্য কত বড় ধরনের ধাক্কা, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বর্তমানে কিয়েভে দায়িত্বরত ব্রিটিশ সাংবাদিক পিটার বাউমন্ট। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তাঁর এই বিশ্লেষণ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বাংলা করা হলো।
ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়াকে যুক্ত করা কার্চ সেতুটি ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ, উচ্চতা স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেয়েও বেশি। সেতুটি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর শীর্ষে রয়েছে, রাজমুকুটের কোহিনূরের মতো। রুশ গণমাধ্যমের ভাষায়, সেতুটি ‘শতাব্দীর সেরা নির্মাণকাজ’।
২০১৮ সালের ১৫ মে কার্চ সেতুর উদ্বোধন করেন পুতিন। সে দিন কমলা রঙের একটি ট্রাক চালিয়ে পুরো সেতুটি পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। বুক ফুলিয়ে সেতুটির গুরুত্ব তুলে ধরতেও ভোলেননি। পুতিন বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, এমনকি জারের শাসনের সময়েও মানুষ সেতুটি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিল। এরপর গত শতকের ত্রিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত চমৎকার এই কাজ শেষ হয়েছে। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের শুরু থেকেই সেতুটির নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। এরই মধ্যে গত শনিবার সকালে শক্তিশালী একটি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সেতুটি। এতে সেটির সড়কপথের একাংশ ধসে যায়। সেতুর রেলপথে থাকা একটি জ্বালানি তেলবাহী ট্রেনের কয়েকটি ট্যাংকারে আগুন লাগে। তবে এই বিস্ফোরণের পেছনের কারণ এখনো জানা যায়নি।
বিস্ফোরণে সেতুটির যে ক্ষতি হয়েছে, তার তাৎপর্য বিশাল—পরোক্ষভাবে হলেও এমনটাই দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তবে তাৎপর্য আদতে কতটুকু, তা কয়েক ঘণ্টা বা দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। এ হামলার জন্য মস্কো প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয় কি না, তা–ও জানা যাবে।
শনিবারের ঘটনার পরপরই অনেক বিশ্লেষক এই হামলা চালানোর দিনক্ষণের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। আগের দিন শুক্রবারই ৭০তম জন্মদিন পালন করেছেন পুতিন। আর হামলাটা এমন সময়ে চালানো হয়েছে, যখন পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর একের পর এক অপমানজনক পরাজয়ের খবর আসছে।
এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যখন ক্রেমলিন থেকে পারমাণবিক হামলার হুমকি আসছিল, তার পরপরই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এর সপ্তাহখানেক আগেই ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত করতে একটি আদেশে স্বাক্ষর করেছেন পুতিন।
তবে এই হামলা যতটা প্রতীকী বলে মনে করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু ক্রিমিয়াই নয়, দক্ষিণ ইউক্রেনে অবস্থান করা রুশ সেনাদের কাছে রসদ পাঠাতে এই সেতু মূল পথগুলোর একটি। এ ছাড়া রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ইউক্রেনের দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান পথ এটি। এই সেতু দিয়েই রেলপথ গেছে ইউক্রেনের মেলিতোপোল পর্যন্ত।
সেতুতে হামলার বিষয়টি নাড়া দিয়েছে ক্রিমিয়ার বাসিন্দাদেরও। হামলার খবর গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পর নিজেদের গাড়িতে জ্বালানি তেল ভরতে ফিলিং স্টেশনগুলোতে ভিড় করেন তাঁরা।
সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্রিমিয়ায় রসদ সরবরাহে মস্কোর কাছে অন্য পথ রয়েছে। এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে ক্রিমিয়ার বন্দরগুলো। তারপরও এই হামলার বড় গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এই সেদিনও মনে করা হতো যে ইউক্রেনের হামলার নাগালের বাইরে রয়েছে রাশিয়া।
তবে বিগত কয়েক মাসে এই ধারণায় বদল আসে। গত আগস্টেই ক্রিমিয়ার সাকি শহরে নৌবাহিনীর বিমানঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। ওই হামলার জেরে ক্রিমিয়ার সমুদ্রসৈকতগুলো থেকে সরে যেতে থাকেন পর্যটকেরা। এতে কার্চ সেতুতে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে গাড়ির সারি দেখা যায়। রাশিয়ার নৌবাহিনীর সদস্যদেরও সতর্কতার সঙ্গে নতুন করে মোতায়েন করা হয়।
এখন সেতুতে এই হামলার জবাব রাশিয়া কীভাবে দেবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। তবে যে বিষয়টি আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে তা হলো, পুতিনের যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা যখন কথা বলতে শুরু করেছেন, সে সময় ইউক্রেনীয় সেনারা সফলভাবে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত এপ্রিলে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনের একজন জেনারেল ক্রিমিয়া সেতুতে (কার্চ ব্রিজ) হামলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছিলেন। আমি আশা করি, তিনি হয়তো এটা বোঝেন যে প্রতিশোধ নিতে রাশিয়াও হামলা চালাতে পারে।’
সবশেষে বলা যায়, সেতুতে হামলার ঘটনা নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশের দিক থেকে কিয়েভের বড় জয় হয়েছে। এই জয় এটাই বোঝায় যে পুতিনের পারমাণবিক হামলার হুমকির তোয়াক্কা করে না তারা, আর বিশ্বাস করে তারাই যুদ্ধে জয় পেতে চলেছে।