কয়েক বছরের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের পর গতকাল বুধবার পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালুর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল ও তুরস্ক। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ এ কূটনৈতিক অগ্রগতিকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং ইসরায়েলের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খবর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বলেছে, কূটনৈতিক উন্নয়নের ফলে আবারও দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রদূত ও কনসাল জেনারেল নিয়োগ করা যাবে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কয়েক মাসের প্রচেষ্টার পর এই সাফল্য দেখা গেল। গত কয়েক মাসে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার দুই দেশ সফর করেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন, দুই দেশে রাষ্ট্রদূতের ফিরে আসাটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির অর্থ এই নয় যে আঙ্কারা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন পরিত্যাগ করছে। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ মুসলিম বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে গাজা, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি স্বার্থের জন্য লবিং করার অনুমতি দেবে।
গত মে মাসে কাভুসোগলু প্রথমবারের মতো ইসরায়েল সফর করেন। ১৫ বছরের মধ্যে কোনো তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম সফর। ওই সময় তিনি দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
কাভুসোগলুর সফরের দুই মাস পরেই ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ ঐতিহাসিক সফরে আঙ্কারা যান। তাঁর এই সফর নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান বলেন, এ সফরই সম্পর্কে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার পর ২০০৮ সালে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তুর্কি মাভি মারমারা জাহাজে ইসরায়েলি হামলার পর ১০ বেসামরিক লোকের মৃত্যুর পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ২০১৬-২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলে। কিন্তু ওই সময় ফিলিস্তিনিদের হত্যার অভিযোগে আবার রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে সীমান্তে প্রতিরোধের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ২০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন।
২০২১ সালে হেরজগ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে আবার চেষ্টা শুরু হয়। গতকাল ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট বলেন, সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের ফলে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পারস্পরিক পর্যটন এবং ইসরায়েল ও তুর্কি জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বকে উৎসাহিত করবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিক না থাকলেও বাণিজ্য অব্যাহত ছিল এবং তুরস্ক ইসরায়েলি পর্যটকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল। ইসরায়েল অবশ্য গত জুন মাসে ইস্তাম্বুলে তাদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইরানি হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছিল। ওই সময় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আঙ্কারাকে ধন্যবাদ জানায় ইসরায়েল।
তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আঞ্চলিক মিত্ররা যাতে মনঃক্ষুণ্ন না হয়, সেই বিষয়ে ইসরায়েল বেশ সতর্ক। হেরজগ তাই আঙ্কারা সফরের আগে সাইপ্রাস ও গ্রিস সফর করেন। এদিকে তুরস্ক বলছে, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে তা ফিলিস্তিনিদের জন্য সুবিধা এনে দিতে পারে। গতকাল কাভুসোগলু বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলেছি, আমরা ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা অব্যাহত রাখব।’
পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের পাশাপাশি গাজা শাসনকারী ইসলামপন্থী দল হামাসের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রেখেছে আঙ্কারা। জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রেসিডেন্ট এফ্রেইম ইনবার বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ১৯৯০-এর দশকের মতোই ভালো হবে, পর্যবেক্ষকদের এমন আশায় থাকা উচিত নয়। এরদোয়ান যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন ইসরায়েলের প্রতি তুরস্কের শত্রুতা থাকবে। এর কারণ তাঁর ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সংযোগ। যেমন তিনি হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাবেন।
২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এ ছাড়া পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে হামাসকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছে।
আঞ্চলিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় ইসরায়েল
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তারই অংশ হিসেবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ড চুক্তির অধীনে ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। একই পথ অনুসরণ করে বাহরাইন ও মরক্কো। আঞ্চলিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া হিসেবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছে ইসরায়েল। সর্বশেষ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো মিসরের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ঠিক হয়নি। এর মধ্যেই তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা এল।