ক্ষমতায় ২৫ বছর: রাশিয়াকে টেনে তুলেছেন, নাকি ডুবিয়েছেন পুতিন
বিবিসির রাশিয়াবিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করছেন রাশিয়ায়। দেখেছেন দেশটিতে ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনের পুরোটা সময়। ৩১ ডিসেম্বর পুতিনের ক্ষমতায় বসার আড়াই দশক পূরণ হচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে পুতিনকে ঘিরে নিজের নানা অভিজ্ঞতা ও অভিমত এ লেখায় তুলে ধরেছেন তিনি।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সেদিন খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের আগমুহূর্তটা কখনোই ভুলব না। তখন বিবিসির মস্কো ব্যুরোয় প্রডিউসার হিসেবে কাজ করতাম। হঠাৎ খবর এল, রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। সেদিন বিবিসির অফিসে কোনো সংবাদদাতা ছিলেন না। ফলে সংবাদ লেখা ও তা সম্প্রচারের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়েছিল।
আমি লিখেছিলাম, ‘বোরিস ইয়েলৎসিন সব সময় বলে এসেছেন, তাঁর পুরো মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে আজ রাশিয়াকে বলেছেন, সেই সিদ্ধান্ত বদলেছেন তিনি।’ এ সংবাদের মধ্য দিয়ে একজন প্রতিবেদক হিসেবে আমার পেশাজীবন শুরু হয়েছিল। একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল রাশিয়ার নেতা হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের পথচলা।
ইয়েলৎসিনের পদত্যাগের পর রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। এর তিন মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় পান তিনি, প্রেসিডেন্ট হন। ক্রেমলিন ত্যাগের সময় পুতিনকে একটি কথা বলেছিলেন ইয়েলৎসিন, ‘রাশিয়ার দিকে খেয়াল রাখবেন।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যখন তিন বছর পূর্তির দিকে এগোচ্ছে, তখন ইয়েলৎসিনের সেই কথা আমার বারবার মনে পড়ছে। কারণ, এ যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। আর এক কোটির বেশি ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিটাও কম নয়। ইউক্রেনে পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে রুশ সামরিক বাহিনী। রাশিয়ার শহরগুলোয় নিয়মিত ড্রোন হামলা হচ্ছে। দেশটির কুরস্ক অঞ্চলের কিছুটা দখলে নিয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা। বড় কথা হলো, রাশিয়ার জনগণের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন বেড়েছে।
২৫ বছর আগে পুতিন যখন প্রথম ক্ষমতায় বসেছিলেন, তখন থেকে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন করছি আমি। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কে ভেবেছিলেন, রাশিয়ার নতুন এই নেতা আড়াই দশক পরেও ক্ষমতায় থাকতে যাচ্ছেন? অনেকে হয়তো চিন্তাও করেননি, একদিন ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের মুখোমুখি হতে হবে তাঁদের।
প্রায়ই মনে হয়, সেদিন যদি ইয়েলৎসিন উত্তরসূরি হিসেবে পুতিনের বদলে অন্য কাউকে বেছে নিতেন, তাহলে ইতিহাসের গতিপথটা অন্য রকম হতো কি না। প্রশ্নটা তাত্ত্বিক। ইতিহাস পর্যালোচনা করতে বসলে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ এবং ‘হতে পারে’—এমন শব্দগুলোর ব্যবহার বারবার আসতে পারে। তবে একটা বিষয় আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ২৫ বছরে আমি পুতিনের বিভিন্ন রূপ দেখেছি।
এ কথা শুধু আমার একার নয়। ২০২৩ সালে সামরিক জোট ন্যাটোর তৎকালীন প্রধান লর্ড রবার্টসন আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাঁর সঙ্গে ভালো কাজ করেছি। একটি ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল করেছি। আজকের দিনে চরম ক্ষমতালিপ্সু পুতিনের চেয়ে আগের পুতিন অনেক ভিন্ন ছিলেন।’
লর্ড রবার্টসন আরও বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, পুতিন একদম সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। দেশের জন্য তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বিশাল। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আজ রাশিয়া এমন কোনো দাবি করতে পারে? আমার মনে হয়, তা পুতিনের অহংবোধে আঘাত করেছে।’
পুতিনের মধ্যে আমি যে পরিবর্তন দেখেছি, তার সম্ভাব্য একটি ব্যাখ্যা হতে পারে এটি। রাশিয়াকে আবার সেরাদের কাতারে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেশটিকে প্রতিবেশী দেশগুলো ও পশ্চিমাদের সঙ্গে অনিবার্য এক সংঘাতে জড়িয়েছে।
তবে এ বিষয়ে ক্রেমলিনের ব্যাখ্যাটা ভিন্ন। পুতিন যেসব ভাষণ দিয়েছেন, যেসব মন্তব্য করেছেন, তা থেকে তাঁর অসন্তোষের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। রাশিয়াকে পশ্চিমারা চারপাশ থেকে পরিবেষ্টিত করে তুলেছে বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন তিনি। নিজ দেশের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
এখানে আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে। সেটি হলো, রাশিয়াকে দেখেশুনে রাখার যে অনুরোধ ইয়েলৎসিন করেছিলেন, তা পূরণ করতে পেরেছেন বলে কি পুতিন মনে করেন? এই প্রশ্নের জবাব বের করার একটি সুযোগ সম্প্রতি আমার হয়েছিল। বছর শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে পুতিন আমাকে একটি প্রশ্ন করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
আমি প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘বোরিস ইয়েলৎসিন আপনাকে রাশিয়াকে দেখে রাখতে বলেছিলেন। তবে অপনার কথিত বিশেষ সামরিক অভিযানে যে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ইউক্রেন বাহিনী কুরস্ক অঞ্চলে প্রবেশ করেছে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এরপরও দেশকে দেখে রাখতে পেরেছেন বলে কি আপনি মনে করেন?’
জবাবে পুতিন বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ। আর আমি শুধু রাশিয়াকে দেখে রাখিনি, দেশটিকে নরকের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছি।’ পুতিনের ভাষ্যমতে, ইয়েলৎসিনের সময় রাশিয়া সার্বভৌমত্ব হারাচ্ছিল। সে সময় পশ্চিমারা রাশিয়াকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছিল। সেখানে তিনি রাশিয়ার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে সবকিছু করছেন।
রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের সুরক্ষাদাতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে পুতিন কি ইউক্রেন যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে চাচ্ছেন, নাকি তিনি নিজেকে সত্যিকার অর্থেই সার্বভৌমত্বের সুরক্ষাদাতা বলে মনে করেন? আমি তা এখন পর্যন্ত জানি না। তবে প্রশ্নটা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে পারি। এ প্রশ্নের জবাবও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তা যুদ্ধের ইতি টানতে এবং রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বড় প্রভাব রাখতে পারে।