পুতিন কেন হামলা করলেন, যুদ্ধ কি শেষ হচ্ছে
কিয়েভ ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বারবার আশঙ্কা প্রকাশ করছিল। তাদের আশঙ্কাকে ‘অমূলক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল মস্কো। তবে শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যি হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর দেশের সশস্ত্র বাহিনী তিন দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। পরবর্তী সময় পশ্চিমা সাহায্য-সমর্থনে বলীয়ান হয়ে ইউক্রেন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাল্টা হামলা শুরু করে। চলমান যুদ্ধ ১১ মাসে গড়িয়েছে। এই যুদ্ধ কবে, কীভাবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা নিয়েই শুরু হচ্ছে আরেকটি নতুন বছর।
হামলার প্রেক্ষাপট
আয়তনের দিক দিয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিক হিসেবে দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার গভীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংযোগ রয়েছে। দেশটিতে রয়েছে রুশ ভাষাভাষী অনেক মানুষ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে বিক্ষোভের মুখে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতন হয়। তখন পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। পরে ইউক্রেনের নতুন সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়। কিয়েভের এই আকাঙ্ক্ষায় ঘোর আপত্তি জানায় রাশিয়া। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন চলে।
হামলা শুরু
হামলার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটায় রাশিয়া। রাশিয়ার এই সামরিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনে হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে ইউক্রেনসহ তার পশ্চিমা মিত্ররা।
তবে মস্কো তা অস্বীকার করে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও সাগর থেকে ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী। যুদ্ধের ঘোষণায় পুতিন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার নাগরিকসহ সাধারণ মানুষকে গণহত্যার হাত থেকে রক্ষায় বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অভিযানের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করা হবে। নাৎসিবাদ দমন করা হবে।
কার শক্তি কত
সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। ইউক্রেনের অবস্থান ২২তম। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ইউক্রেনের কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই। মূলত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্রের সহায়তায় এখন রাশিয়াকে পাল্টা জবাব দিচ্ছে ইউক্রেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিয়েভকে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যুদ্ধে ইউক্রেনকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
কার পক্ষে কারা
যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে রয়েছে ইরান ও বেলারুশ। রুশ বাহিনীকে ড্রোন সরবরাহ করছে তেহরান। ইউক্রেনে হামলায় এই ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া। অন্যদিকে, বেলারুশকে ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বস্ত মিত্র বলে মনে করছেন পুতিন। ১৯ ডিসেম্বর তিনি বেলারুশ সফরে যান। দেশটির নেতা আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে বৈঠক করেন। অপর দিকে, কিয়েভের পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ অনেক দেশ ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে পশ্চিমারা। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞার নিশানায় পড়েছে রাশিয়ার তেল, গ্যাস, ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাত। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের আকাশসীমায় রাশিয়ার উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন।
চার অঞ্চল দখল
গত সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করে মস্কো। এই গণভোটের মধ্য দিয়ে অঞ্চল চারটিকে নিজেদের অধিভুক্ত করে নেয় রাশিয়া। দখলকৃত এই অঞ্চলগুলোর আয়তন ইউক্রেনের মোট ভূমির প্রায় ১৫ শতাংশ। পশ্চিমারা এই গণভোটকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে মস্কো বলছে, অঞ্চলগুলো চিরদিনের জন্য রাশিয়ার হয়ে গেছে। মস্কো এমন দাবি করলেও এখন এসব অঞ্চলেই যুদ্ধ হচ্ছে।
হামলা জোরদার
অক্টোবরের দিকে নতুন কৌশল নেয় রুশ বাহিনী। তখন থেকে তারা বিশেষ করে ইউক্রেনের বৈদ্যুতিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালাতে থাকে। পাশাপাশি তারা ইউক্রেনে পানি সরবরাহ অবকাঠামো ও হিটিং-ব্যবস্থা হামলার লক্ষ্যবস্তু করছে। ইউক্রেনজুড়ে ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় দেশটিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। বিদ্যুৎসেবা, পানি সরবরাহব্যবস্থা ও হিটিং-ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব সেবা বিচ্ছিন্ন থাকায় তীব্র শীতের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে ইউক্রেনের অনেক এলাকার বাসিন্দাদের।
শীতকে অস্ত্র বানাচ্ছে রাশিয়া
ইউক্রেনে শীত জেঁকে বসেছে। দেশটিতে এখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে বা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকছে। এই সময় বৈদ্যুতিক স্থাপনা, হিটিং-ব্যবস্থা ও পানি সরবরাহব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে রুশ বাহিনীর হামলা জোরদারের জেরে কিয়েভ বলছে, শীতকে অস্ত্র বানাচ্ছে রাশিয়া। ন্যাটোর পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ করা হচ্ছে।
পাল্টা হামলা, ভূমি পুনরুদ্ধার
পশ্চিমাদের অস্ত্র সহায়তা নিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দখলকৃত এলাকার পাশাপাশি তারা রাশিয়ার ভেতরেও হামলা চালাচ্ছে। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি খেরসন অঞ্চলের রাজধানী খেরসন শহর পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেন। এই অর্জনকে ‘যুদ্ধ সমাপ্তির সূচনা’ হিসেবে বর্ণনা করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের গত ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া যে ভূখণ্ড দখল করেছিল, তার ৫৪ শতাংশ পুনরুদ্ধার করেছে ইউক্রেন। অন্যদিকে, ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের’ তথ্যমতে, ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে ৭৪ হাজার ৪৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে ইউক্রেন। বর্তমানে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক লড়াই চলছে।
পরিস্থিতি জটিল
ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর ৩০০তম দিন ছিল ২০ ডিসেম্বর। এদিন রাজধানী মস্কোয় রুশ নিরাপত্তা বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ভাষণে তিনি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, ইউক্রেনের অধিকৃত চারটি অঞ্চলের পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত জটিল’। এ অবস্থায় রুশ নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি। একই সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীকে যেকোনো নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেন।
বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি
ইউক্রেনের সামরিক কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া সম্ভবত আগামী বছরের শুরুর দিকে নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছে। সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি বলেন, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে নতুন করে হামলার জন্য রাশিয়া প্রায় দুই লাখ সেনা প্রস্তুত করছে। এই পরিস্থিতিতে রুশ হামলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, তাঁদের আরও অস্ত্র, গোলাবারুদ, আধুনিক ট্যাংক প্রয়োজন। দীর্ঘ পাল্লার অস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দরকার। আরও সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২১ ডিসেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান।
হতাহতের সংখ্যা
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, যুদ্ধে প্রায় এক লাখ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। এক থেকে দেড় লাখের মতো রুশ সেনা আহত, নিখোঁজ বা যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরতে অক্ষম হয়েছেন। আর যুদ্ধে ইউক্রেনের ১০ থেকে ১৩ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। তবে গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ জেনারেল মার্ক মিলে বলেছিলেন, ইউক্রেনে এক লাখের বেশি রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছেন। ইউক্রেনীয় বাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও সম্ভবত একই। যুদ্ধে হতাহতের যে পরিসংখ্যান বিভিন্ন পক্ষ দিচ্ছে, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করে নিশ্চিত করতে পারেনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
সমঝোতা কত দূর
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মাঝে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা হালে পানি পায়নি। চলতি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির একটি শান্তি প্রস্তাব নাকচ করে রাশিয়া। জেলেনস্কি তাঁর শান্তি প্রস্তাবে রুশ সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি করেছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব নাকচ করে বলা হয়, কিয়েভকে নতুন আঞ্চলিক বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। নতুন বাস্তবতাগুলোর মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চল অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি রয়েছে। এসব এলাকা গণভোটের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে না নিলে কোনো ধরনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তা ছাড়া, জেলেনস্কি যে তিন ধাপের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে চলতি বছরের শেষ দিক থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
যুদ্ধ বন্ধে বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে কোনো সংলাপ হচ্ছে না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, আরেকটি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতে এখনই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার উপযুক্ত সময়।
তবে এরপরেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা বাবদ ৪৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমা অর্থ ও অস্ত্রে শক্তি অর্জন করে চলছে ইউক্রেন। তাই এই যুদ্ধ শিগগির থামছে না। যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা ব্যাপক।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, রয়টার্স, এএফপি।