ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাদের চেয়ে গোয়েন্দারা বেশি সফল
ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চেয়ে গোয়েন্দারা বেশি সফল। এমনই দাবি করেছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বিষয়ক থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট। সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২১ সালের জুন থেকে ইউক্রেন আগ্রাসনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ বাহিনী ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখলের পরপরই রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) এসব এলাকার বাসিন্দাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। থিঙ্কট্যাংকটির দাবি, এ–সংক্রান্ত নথিপত্র ও অন্য একাধিক সূত্র ব্যবহার করে তারা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
সংস্থাটি বলছে, এই প্রতিবেদন তৈরিতে ইউক্রেনের গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসা যোগাযোগের তথ্য ও মাঠপর্যায়ের গবেষণারও অবদান আছে।
গবেষকেরা বলছেন, কিয়েভপন্থী যেসব ব্যক্তিকে এফএসবি গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়, তাঁদের শনাক্তে সরকারি কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ ডাউনলোডের সুযোগও দেওয়া হয় এফএসবি গোয়েন্দাদের।
সংস্থাটির দাবি, দখল করা ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার মোতায়েন করা হয়েছে।
থিঙ্কট্যাংকটির ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার বিদেশবিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা এসভিআরের প্রধান প্রস্তুতির জন্য তাঁদের আরও সময় প্রয়োজন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেন আগ্রাসন বিলম্বিত করার অনুরোধ করেছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর এ অনুরোধে সাড়া দেননি।
‘প্রিলিমিনারি লেসনস ফ্রম রাশিয়াস আনকনভেনশনাল অপারেশনস ডিউরিং দ্য রুশো–ইউক্রেনিয়ান ওয়্যার: ফেব্রুয়ারি ২০২২–ফেব্রুয়ারি ২০২৩’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন ৩৯ পৃষ্ঠার। ‘টার্গেট’ দেশকে ধ্বংসের জন্য রাশিয়ার গোপন অভিযান সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করাই এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য।
‘অতি গোপনীয় তথ্য’ মস্কোকে দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি জার্মানির এক জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক জ্যাক ওয়াল্টিং।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এটা নিশ্চিত, আগ্রাসন চালানোর আগে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইউক্রেনে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে বড় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে। তবে আগ্রাসনের পরও বিশেষ এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এ কাজের জন্য কেজিবির উত্তরসুরি হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ গুপ্তচর সংস্থা এফএসবি অস্থায়ীভাবে ছোট কিছু দল গঠন করে মেলিতপোলের মতো নিশানা করা বিভিন্ন শহরে কার্যক্রম চালায়।
রুশ বাহিনী যখনই ইউক্রেনের কোনো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, সঙ্গে সঙ্গে এফএসবির কর্মকর্তারা সেসব এলাকায় থাকা স্থানীয় সরকারি দপ্তরগুলো থেকে সরকারি নথি জব্দ ও কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভের তথ্য নিজেদের কাছে নিয়ে নেন। এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষে–বিপক্ষে কারা কাজ করছেন এবং তাঁরা কোথায় আছেন, তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়।
এরপর ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে রুশবিরোধীদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওয়াল্টিং বলেন, মাঝেমধ্যে নির্যাতন করার ঘটনাও ঘটত। এটা যে কেবল তথ্য বের করার জন্য করা হতো, তেমনটা নয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে অন্যদের বার্তা দেওয়া এবং দখল করা এলাকার মানুষ যাতে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার সাহস না পায়, সেটাই থাকে বড় উদ্দেশ্য। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ উঠলেও মস্কো বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে।
ইউক্রেনের অন্তত ৮০০ সরকারি কর্মকর্তাকে এফএসবির পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায়, আবার কেউ জোরাজুরির কারণে ভয়ে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।
একই সময়ে ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার ইউনিট ইউক্রেনীয় মানুষদের টিভি, রেডিও ও ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কাজটি করতে থাকে। এতে করে দখল করা এলাকার মানুষ আরও একঘরে হয়ে পড়ে।
ওয়াল্টিং বলেন, এফএসবি নানাভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখে, যেকোনো একটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সেই এলাকার মাত্র ৮ ভাগ মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই যথেষ্ট।
সামগ্রিক ছবিটা হলো, রাশিয়ার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের সামরিক বাহিনীর চেয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে বেশি সফল হয়েছে। কারণ, ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে অনেক সময় পিছু হটতে হয়েছে। অনেক সেনা হতাহত হয়েছেন, কোথাও কোথাও ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে পরাজিতও হতে হয়েছে।
তবে রুশ গোয়েন্দাদেরও ব্যর্থতা ছিল। ইউক্রেনে অভিযান চালানোর আগে তাঁরা যেসব মূল্যায়ন হাজির করেছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, রাশিয়ার সেনাদের সাদরে গ্রহণ করা হবে এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিয়েভ সরকারের পতন ঘটবে। অভিযানপূর্ববর্তী গোয়েন্দাদের এমন মূল্যায়ন মস্কোর জন্য ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিশ্রম করে নিজেরা যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, তার সত্যিটা তুলে ধরার সাহস তাদের নেই। এখানে একটা পদ্ধতিগত সমস্যা দেখা গেছে। যেমন ঊর্ধ্বতনদের কাছে একজনের সাফল্যের বিষয় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হলেও দুর্বল বিষয়গুলো গোপন রাখা হয়।’