গর্বাচেভ ও পুতিনের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর
সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ৯১ বছর বয়সে মারা গেলেন। তাঁর সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্কটা ঠিক ব্যাখ্যা করা কঠিন। ২০ বছরেরও বেশি সময় পুতিনকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখেছেন গর্বাচেভ। এ সময়ের মধ্যে কখনো তিনি পুতিনের সমালোচনা করেছেন, আবার কখনো করেছেন প্রশংসা।
পুতিনের প্রশংসা করে কখনো সমালোচনার মুখেও পড়েছেন গর্বাচেভ। ২০১৮ সালে পুতিন যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, তখন গর্বাচেভ বলেছিলেন, বর্তমান সময়ে পুতিন এমন একজন নেতা, যিনি প্রাপ্য জনসমর্থন পেয়ে আসছেন।
গর্বাচেভ শাসনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে নয়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন বরিস ইয়েলেৎসিন। এই নেতার সময়ে রাশিয়ার অবস্থা বেশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ফলে ২০০০ সালে পুতিন যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন তাঁর প্রশংসা করেছিলেন গর্বাচেভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সাবেক এজেন্ট পুতিনকে নিয়ে বেশ আশাবাদীও ছিলেন গর্বাচেভ। ওই সময় গর্বাচেভ বলেছিলেন, ‘পুতিন বুদ্ধিমান, একনিষ্ঠ, সবকিছুতে গা ভাসিয়ে দেন না এবং সুসংগঠিত। আমি এ ধরনের মানুষ পছন্দ করি।’
শুধু এই নির্বাচন নয়, পরবর্তী সময়েও পুতিনের পক্ষে ছিলেন গর্বাচেভ। সেই সময় গর্বাচেভের ধারণা ছিল, পুতিনের হাত ধরে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা আসবে। কিন্তু গর্বাচেভের এই ধারণা পরবর্তী সময়ে ভেঙে যায়। রাশিয়ার যে গণতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন গর্বাচেভ, তা পুতিনের হাতে হয়নি। ফলে একসময় পুতিনের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। পুতিনকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি তিনি।
২০১১ সালে রাশিয়ায় পার্লামেন্টে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এতে পুতিনের বিষয়ে গর্বাচেভের মনোভাব বদলে যায়। এ ছাড়া সে সময় পুতিন তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে কঠোর সমালোচনা করেন গর্বাচেভ। এমনকি ওই নির্বাচনের পর পুতিনের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তাতেও সমর্থন দেন গর্বাচেভ।
তখন পুতিনকে একহাত নিয়ে গর্বাচেভ বলেছিলেন, রাজনীতি দিন দিন আরও বেশি মেকি গণতন্ত্রে রূপ নিচ্ছে। সব ক্ষমতা শাসকগোষ্ঠী ও প্রেসিডেন্টের হাতে। তিনি বলেছিলেন, অর্থব্যবস্থা একচেটিয়া হয়ে পড়েছে। রাশিয়ায় সর্বত্র দুর্নীতি হচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্ব তখন প্রায়ই গর্বাচেভের বক্তব্য প্রচার করত। এ ছাড়া ক্রেমলিনবিরোধী সংবাদপত্র নোভায়া গাজেতাও তাঁর খবর প্রচার করত। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর পত্রিকাটি ছাপা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পুতিন অবশ্য গর্বাচেভকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাঁকে কাঁটা হিসেবেই বিবেচনা করতে পুতিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনকে বিশ শতকের হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে আখ্যা দেন পুতিন। তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিরোধিতা করায় গর্বাচেভের সমালোচনা করেছিলেন পুতিনও। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্যও তাঁকে সমালোচনা করেছিলেন পুতিন।
তবে এ অবস্থা ২০১৪ সালে গিয়ে খানিকটা বদলে গিয়েছিল। ওই সময় ইউক্রেনের ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয় রাশিয়া। পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা সত্ত্বেও মস্কোর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন নোবেল বিজয়ী গর্বাচেভ। সেই সময় সোভিয়েতের এই নেতা বলেছিলেন, ক্রিমিয়া মানে রাশিয়াই। কেউ পারলে এর বিপরীতটা প্রমাণ করে দেখাক। এর পরের বছর ২০১৫ সালে সিরিয়ায় যে সামরিক অভিযান রাশিয়া শুরু করেছিল, তা–ও সমর্থন করেছিলেন গর্বাচেভ।
পুতিন তৃতীয়বার যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন সমালোচনা করলেও চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় আর সমালোচনা করেননি গর্বাচেভ। বরং সেই সময় তিনি বলেছিলেন, জটিল এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ায় পুতিনের মতো নেতা প্রয়োজন।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, জীবনের অন্তিম বেলায় গর্বাচেভ পুতিনের মতো এমন একজন মানুষকে সমর্থন করে গেছেন, যিনি কিনা তাঁকে নিয়ে ভাবেননি এবং গর্বাচেভের অনেক কাজই বাতিল তরে দিয়েছেন পুতিন।
গর্বাচেভের দরজা সব সময় খোলা ছিল বিরোধীদের জন্য এবং তাঁর আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু পুতিনের আমলে রাশিয়া মুক্তমত রুদ্ধ হয়েছে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
মারা যাওয়ার পর যে শোকবার্তা পুতিন দিয়েছেন, তাতেও গর্বাচেভের অর্জন খুবই কম উঠে এসেছে। শোকবার্তায় পুতিন লিখেছেন, গর্বাচেভ এমন একজন রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, যিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিশাল প্রভাব ফেলেছেন। গর্বাচেভ এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি জরুরি যেকোনো সমস্যায় নিজে সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছেন।