ইউক্রেন যুদ্ধে আলু পুড়ে খাচ্ছে ভারত-চীন
ইউক্রেন যুদ্ধ সুস্পষ্ট দুটি প্রতিপক্ষকে সামনে এনেছে। একটি পক্ষে ইউক্রেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব। আরেকটি পক্ষে রাশিয়া ও তাঁর পূর্ব ইউরোপের মিত্ররা। দ্বিতীয় পক্ষে শক্তিশালী দেশের সংখ্যা কম। কিন্তু এ দুই পক্ষের বাইরে গিয়ে দুটি দেশ বাণিজ্য চাঙা করেছে। এরা হলো চীন ও ভারত।
অবস্থা দৃষ্টিতে, ইউক্রেনের ঘর যখন পুড়ছে, তখন তা নেভানোর চেষ্টা না করে সুযোগ বুঝে সেখানে আলু পোড়া দিয়ে খাওয়ার চেষ্টায় মত্ত রয়েছে এ দুই দেশ।
কীভাবে সেটা হচ্ছে, পরিসংখ্যানে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে তার মূল্যমান ৩ হাজার ২৮৮ কোটি মার্কিন ডলার (৩ লাখ ৪৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা প্রায়)। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ঠিক এই সময়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৫৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভারত–রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ।
রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি কিনেছে তেল। কয়েক মাস ধরে দেশটি থেকে তেল কেনায় রেকর্ড গড়ছে ভারত। ভারতের ইকোনমিক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারিতে রাশিয়ার কাছ থেকে দিনে ১৪ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে ভারত। ওই মাসে ভারত বিশ্ববাজার থেকে যত তেল কিনেছে, এর ২৮ শতাংশই কিনেছে রাশিয়া থেকে। অথচ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর আগে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনার পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। এক বছরে তা ২৮ শতাংশে উঠেছে।
অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের কাছ থেকে ভারতের তেল কেনা কমেছে। রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালে ভারত ৮৭ শতাংশ তেল কিনেছে ওপেকভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকে। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশে। অর্থাৎ নয়া বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ওপেকের ওপর তেলের নির্ভরতা কমিয়েছে ভারত।
ভারত পশ্চিমাদের মিত্র। আবার একই সঙ্গে রাশিয়ার পুরোনো বন্ধুও। ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের চাপাচাপির পরও সরাসরি তাদের পাশে দাঁড়ায়নি ভারত। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নতুন যে শীতল যুদ্ধে বিশ্ব জড়িয়ে পড়েছে, ভারত তা থেকে দূরে থাকছে ও সুবিধা নিচ্ছে। এ যুদ্ধের কারণে ইউরোপ রাশিয়ার ওপর থেকে জ্বালানিনির্ভরতা কমাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া বিশ্ববাজারের তুলনায় কম দামে তেল বিক্রি করছে। সেই সুযোগে কম দামে বেশি তেল কিনছে ভারত।
ভারতের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছে পশ্চিমারা। ভারত এতে পাত্তা দিচ্ছে না। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জিজ্ঞাসা করা হয়, ভারত কেন পশ্চিমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়ার তেল কিনছে? জবাবে জয়শঙ্কর বলেছেন, যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ রাশিয়ার তেল কিনেছে ভারতের চেয়ে ছয় গুণ, তাহলে ভারত কেন কিনবে না?
এটাই আসলে বাস্তবতা। রাশিয়ার তেলের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা শূন্যের কোঠায় আনতে পারেনি ইউরোপ। নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনেছে তারা। রাশিয়ার ওপর জ্বালানিসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে রুশ অভিযানের প্রথম ১০০ দিনে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে ৯ হাজার ৩০০ কোটি ইউরো আয় করেছে মস্কো। ফিনল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারে (সিআরইএ) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই আয়ের বেশির ভাগই এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ থেকে। অথচ রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারাই।
রাশিয়া-চীন বাণিজ্য ফুলে ঢোল
এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, আর যারই বন্ধু হোক যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হতে পারবে না চীন। এই দুই দেশের বৈরিতা কত দূর গড়াতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে টের পাওয়া গেছে। একের পর এক পণ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল সেই সময়। এমনকি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে কথার লড়াইও শুরু করেছিলেন ট্রাম্প। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নেই চীনের। ফলে নিষেধাজ্ঞায় পর্যুদস্ত রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ব্যবসা করতে চীনের বাধা ছিল না।
আর সেটাই হয়েছে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গত বছর চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য নতুন এক রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর পরিমাণ ১৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার (১৯ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা প্রায়)। ২০২১ সালের তুলনায় এই বাণিজ্য বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
যদিও চীনের যে মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, তা রাশিয়ার সঙ্গে তার বাণিজ্যের প্রায় ৩৩ গুণ। কারণ দুই দেশের মধ্যে যে পরিমাণ বাণিজ্য হয়েছে তা চীনের মোট বাণিজ্যের ৩ শতাংশ। তবে এই বাণিজ্য বাড়ছে। ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রথম ছয় মাসের তুলনায় বেড়েছে।
রাশিয়া যেসব পণ্য চীনে রপ্তানি করেছে সেসবের মধ্যে অন্যতম তরলীকৃত গ্যাস। রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের দেওয়া তথ্য অনুসারে, পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইন ব্যবহার করে চীনে রাশিয়ার তরলীকৃত গ্যাস রপ্তানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া অপরিশোধিত তেল রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পেত যদি করোনা মহামারি বাধা না হতো। এর অবশ্য উদাহরণও রয়েছে। যেমন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। এতে নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে রাশিয়ায় চীনের রপ্তানি কমে যায়।
অনড় অবস্থানে ভারত-চীন
চীন ও ভারত যাতে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য না করে, এ জন্য চেষ্টাচরিত কম করেনি পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে চীনকে পাশে চেয়েছিল জার্মানি। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি চীন। আবার রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে ভারতকে পাশে চেয়েছিল পশ্চিমারা। ভারতও রাজি হয়নি। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাব পাসের সময়ও চীন-ভারতকে পাশে পায়নি তারা।
বিপরীতে ভারত তার স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। গত বছরের অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই লাভবান হয়নি। যাঁরা যুদ্ধে জড়িয়েছেন, তাঁরা যেমন লাভবান হননি, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও লাভ হয়নি।
ভারতের এ অবস্থানকে ভালোভাবে দেখেনি পশ্চিমারা। তবে ভারত এতে পাত্তা দেয়নি। উল্টো পশ্চিমা মিত্রদের একহাত নিয়েছেন জয়শঙ্কর। গত বছর স্লোভাকিয়ায় একটি সম্মেলনে অংশ নিয়ে রাশিয়া থেকে ইউরোপের দেশগুলোর গ্যাস কেনার বিষয়টি সামনে এনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনা কি যুদ্ধে তহবিল দেওয়ার শামিল নয়? তিনি আসলে ওই সম্মেলনে এটাই বলতে চেয়েছেন, ভারত যদি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার মাধ্যমে যুদ্ধে অর্থ দিয়ে থাকে, তাহলে ইউরোপ কী করছে? রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস কিনে তারাও তো যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই অর্থ দিচ্ছে।
চীন অবশ্য এ পথে হাঁটেনি। তারা সরাসরি বলে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়া-চীন বাণিজ্য সম্পর্কে ফাটল ধরানো যাবে না। উল্টো ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চীন। ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা এসেছে পশ্চিমাদের কাছ থেকে। ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে তারা। এই যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র দেওয়া, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তা নিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসে নিবন্ধ লেখা হয়েছে। পত্রিকাটি বলছে, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে স্বাভাবিক বাণিজ্য রয়েছে সেটা সহ্য করতে পারে না পশ্চিমা বিশ্ব।
ভারত ও চীন তাদের অবস্থানে অনড়। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন না হলে যুদ্ধ যত দিন চলবে, তত দিন লাভবান হবে দুটি দেশ। এখন দেখার বিষয়, পশ্চিমা বিশ্ব ভারত ও চীনের সঙ্গে রাশিয়ার দহরম-মহরম সম্পর্ক কত দিন সহ্য করতে পারে।