বিয়ের পর মাত্র পাঁচ দিন একসঙ্গে ছিলেন ইউক্রেনের এই দম্পতি

বিয়ের মাত্র পাঁচ দিন পর যুদ্ধে স্বামীকে হারান এরিকা মার্টিনিউক
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হন এক ইউক্রেনীয় সেনা। সেভেলি ফেদান নামের এই তরুণের ছিল বয়স মাত্র ২১। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রেমিকা এরিকা মার্টিনিউকের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর মাত্র পাঁচ দিন একসঙ্গে ছিলেন তাঁরা। এরপরই যুদ্ধে নিহত হন তিনি।

তরুণ সেভেলি ফেদানের লাশটা ছিল অর্ধগলিত, মুখটাও মারাত্মক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। ফেদানের বিকৃত মুখ দেখে তাঁর লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। পরে শরীরের উলকি দেখে চেনা সম্ভব হয়। এই নির্মম ঘটনা বিশ্বকে দেখাচ্ছে, একটা যুদ্ধ বা সংঘাত কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

আরও পড়ুন

কিয়েভের একটি পার্কে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফেদানের স্ত্রী এরিকা বলেন, ‘যখন আমি মর্গে তার লাশ দেখি, তখন মনে হয়েছিল আমিও মারা গেছি।’

খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই ধাক্কা এরিকার জীবনকে পুরো বদলে দিয়েছে। এখন আর স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি।

এরিকা-ফেদানের প্রেমের গল্প বেশ পুরোনো। কৈশোরে এক গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে তাঁদের প্রথম পরিচয়। এর কয়েক বছর পর তাঁদের আবার দেখা হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে দুজন দুজনের প্রেমে পড়েন। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধে যেতে হয় ফেদানকে। যুদ্ধে যাওয়ার এক দিন আগেই ফেদান আর এরিকা বিয়ে করেন।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে কতজন তরুণ সেনা নিহত হয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই
ছবি: এএফপি

এরিকার স্বপ্ন ছিল, অন্তত এক দিন যুদ্ধের কথা ভুলে গিয়ে দুজনে একসঙ্গে সময় কাটাবেন। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যুদ্ধে চলে যান ফেদান।

ফেদান বাখমুতের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বেঁচে ফিরে আসেন, কিন্তু আগস্ট মাসের শেষ দিকে জাপোরিঝঝিয়া যুদ্ধে প্রাণ হারান।

আরও পড়ুন

এরিকার গল্প ইউক্রেনে এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে অনেক তরুণী অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন। তাঁদের জীবন কাটাতে হয় একা। শুধু স্বামী হারানোর বিয়োগব্যথাই নয়, সমবেদনা জানাতে গিয়ে আত্মীয়রাও তাঁদের দুঃখটাকে খুব ছোট করে দেখেন। যুদ্ধের কাছে তাঁদের দুঃখ যেন কিছুই নয়। এতে নারীদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে ঠিক কতজন সেনা মারা গেছেন, ইউক্রেন এখনো তা প্রকাশ করেনি। এ জন্য ইউক্রেনীয় তরুণীদের মধ্যে বিধবার সংখ্যাটা অনুমান করাও কঠিন। ইউক্রেনীয় নাগরিক উখসানা বরকুন একটি অনলাইন কমিউনিটিতে জরিপ করেছেন। কমিউনিটি জরিপে দেখা যায়, ফেসবুক গ্রুপে থাকা ২ হাজারের মধ্যে ৭ শতাংশ নারী বিধবা হয়ে গেছেন, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।

এরিকার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে ২২ বছর বয়সী ইংরেজি শিক্ষক ডারিনা ভয়েভোডিনার জীবনেও। তিনিও যুদ্ধে স্বামীকে হারান। আগস্টের ২০ তারিখ আগর ভয়েভোডিনার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। স্বামী পেশায় ছিলেন জাপানি ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক। দেশের জন্য স্নাইপার হাতে যুদ্ধের মাঠে নামেন আগর। বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় মারা যান তিনি।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে কতজন তরুণ সেনা নিহত হয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই
ছবি: এএফপি

স্বামীর অকালমৃত্যু এখনো অবিশ্বাস্য মনে হয় ডারিনার। তিনি এখনো আশা করেন, খুব শিগগিরই ফিরে আসবেন আগর।

এই যুদ্ধ ইউক্রেনের এ প্রজন্মের জন্য বিভীষিকার রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে তারা সুন্দর দিন হয়তো কাটাবে, কিন্তু এই যুদ্ধ তাদের জীবনকে নিরানন্দ করে দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে উদ্যমী তরুণ ও বিচক্ষণ মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছেন।

সাক্ষাৎকার শেষে এরিকার ২২ বছর বয়সী বান্ধবী কাটইয়া পার্কে আসেন। এই কাটইয়ার বাগ্‌দত্তা মাত্র দুই দিন আগে যুদ্ধে প্রাণ হারান। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! যাঁর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করতে হবে কাটইয়ারকেই।
ইউক্রেনের আকাশ ভারী হয়ে যাচ্ছে লাশের গন্ধে আর যুদ্ধের বিধ্বস্ততায়। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু যুদ্ধাবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। এভাবে আর কত দিন চলবে, তা কেউ জানে না।