রানির আয়ের উৎস সম্পর্কে যা জানা যায়
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন সিংহাসনে বসবেন তাঁর ছেলে প্রিন্স চার্লস। এখন থেকে নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচয় দেবেন। রানির মৃত্যুর পর ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কে জানা যাচ্ছে নানা তথ্য। রানির আয়ের উৎস সম্পর্কে বিবিসির প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য জানা গেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেসব উৎস সম্পর্কে।
রানির আয়ের উৎস
সার্বভৌম অনুদান নামে পরিচিত করদাতা তহবিলের মাধ্যমে আয়ের একটি বড় অংশ আসত রানির। ব্রিটিশ রাজপরিবারকে এর মাধ্যমে বার্ষিক অর্থ দেওয়া হয়। রাজা তৃতীয় জর্জের সময় করা একটি চুক্তির মাধ্যমে এই তহবিল গঠিত হয়েছিল।
বাকিংহাম প্যালেস প্রকাশিত এক প্রতিবেদেন থেকে জানা গেছে, এই তহবিল থেকে ২০২১–২২ সালে রাজপরিবারের জন্য ৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড (৯৪৮ কোটি টাকা ) নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১০ বছর ধরে বাকিংহাম প্যালেসের সংস্কারের জন্য এই খরচ বাড়াতে হয়েছিল। তবে এ জন্য বিগত বছরগুলোয় সার্বভৌম অনুদান তহবিল থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থ থেকে ঘাটতি মেটানো হয়েছিল।
তহবিলের টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় করা হয়
সার্বভৌম অনুদান তহবিল অফিশিয়াল ভ্রমণ, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং রানির পরিবারের পরিচালন খরচের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অভ্যর্থনা, গার্ডেন পার্টি ও স্কুল পরিদর্শনেও খরচ করা হয় কিছু অর্থ। গত বছর ২ হাজার ৩০০টি রাজকীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
করোনা মহামারি–পরবর্তী বিধিনিষেধ শিথিল করায় ২০২১–২২ সালে রাজপরিবারের ভ্রমণ খরচ ১৩ লাখ পাউন্ড থেকে বেড়ে ৪৫ লাখ পাউন্ডে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ২৬টি ভ্রমণ করা হয়েছে, যার প্রতিটিতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার পাউন্ডের বেশি। গত বছর কর্নওয়ালে জি–৭ নেতাদের অভ্যর্থনায় যোগ দিতে রানির একটি রয়্যাল ট্রেনযাত্রায় খরচ হয় ৩১ হাজার ৭৯৬ পাউন্ড (প্রায় ৩৫ লাখ টাকা)। তবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল যাত্রা ছিল ডিউক ও ডাচেস অব কেমব্রিজের ক্যারিবিয়ান সফর। গত মার্চ মাসে ওই সফরে খরচ করা হয়েছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৬ পাউন্ড।
তহবিলের বেশির ভাগ অর্থ খরচ করা হয়েছে রাজপ্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মীদের বেতনের জন্য। গত বছর রানি এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের জন্য বাকিংহাম প্যালেসের সংস্কারকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ৫৫ লাখ পাউন্ড খরচ করা হয়।
সার্বভৌম অনুদানের জন্য অর্থ কোথা থেকে আসে
রাজপরিবারের এস্টেটের লাভের ওপর ভিত্তি করে এ অর্থ দেওয়া হয়। এটি মূলত একটি সম্পত্তি ব্যবসা, যা রাজপরিবারের মালিকানাধীন হলেও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। এসব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে শপিংয়ের জন্য বিখ্যাত লন্ডনের রিজেন্ট স্ট্রিট ও বার্কশায়ারের অ্যাসকট রেসকোর্স। এখান থেকে আসা লাভের অর্থ তহবিলে যোগ হয়।
এসব সম্পত্তি রানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির অংশ নয়। এগুলো কেবল রাজপরিবারের সম্পত্তি। এর মানে হলো রানি এই এস্টেট বিক্রি করতে পারবেন না। আবার এখান থেকে আয় হওয়া অর্থও নিজে খরচ করতে পারবেন না।
সার্বভৌম অনুদান কীভাবে গণনা করা হয়
রানিকে দুই বছর ধরে ক্রাউন এস্টেটের লাভের ১৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। বাদবাকি অর্থ জমা হয় সরকারি তহবিলে। তবে ২০১৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর রানি ২৫ শতাংশ অর্থ নিতে পারবেন বলে সরকার রাজি হয়েছিল। মূলত, বাকিংহাম প্যালেসের সংস্কারকাজের জন্য সরকার এটা দিতে রাজি হয়।
ক্রাউন এস্টেটের ইতিহাস
ক্রাউন এস্টেট মূলত রাজতন্ত্রের মালিকানাধীন জমিগুলোর নাম। নরম্যান বিজয়ের সময় থেকে এগুলো রাজতন্ত্রের সম্পত্তি হয়।
রাজা তৃতীয় জর্জ ১৭৬০ সালে ক্রাউন এস্টেট থেকে পাওয়া আয় হস্তান্তর করার জন্য সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। বিনিময়ে রাজা ও তাঁর উত্তরসূরিরা একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক অর্থ পাবেন বলে চুক্তিতে বলা হয়েছিল, যেটি মূলত সিভিল লিস্ট নামে পরিচিত। ২০১০ সালে সিভিল লিস্টের নাম পরিবর্তন করে সার্বভৌম অনুদান করা হয়।
আয়ের আরও উৎস
রানির আয়ের অন্য এক বিরাট উৎস দ্য ড্যাচি অব ল্যাংকেস্টার। এটি মূলত ব্রিটেন রাজপরিবারের বাণিজ্যিক, কৃষিজাত ও আবাসিক সম্পত্তি। তবে এটি সরকারি সম্পত্তি নয়, বরং উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া পারিবারিক সম্পত্তি। রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর বড় মেয়ে হিসেবে এই সম্পত্তি বুঝে পান রানি এলিজাবেথ। তাঁর মৃত্যুর পর এখন এ সম্পত্তির মালিক হবেন প্রিন্স চার্লস।
ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারের মতো এলাকায় ১৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমি আছে। এ ছাড়া সেন্ট্রাল লন্ডনেও আছে এসব জমি। এসব সম্পত্তি থেকে প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি পাউন্ড আয় হয়।
ইংল্যান্ডের বাইরে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ডেও ক্রাউন এস্টেটের সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া স্কটল্যান্ডের বালমোরালে যেখানে রানি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেটি রানির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। রাজপরিবারের কিছু কিছু সদস্যের ব্যক্তিগত বিমান, গয়না ও স্টাম্প সংগ্রহশালা আছে।
নিরাপত্তা ব্যয়
অনেকেই বলেন, রাজপরিবারের প্রকৃত খরচ জনসমক্ষে যা প্রচার করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, নিরাপত্তার জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়, সেটি সার্বভৌম অনুদান দেয় না। এর ব্যয়ভার সাধারণত মেট্রোপলিটন পুলিশ বহন করে থাকে।
রিপাবলিক নামের একটি সংস্থা নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে খবরাখবর দিয়ে থাকে। সংস্থাটি অনুমান করছে, নিরাপত্তা খরচসহ রাজতন্ত্রের মোট বার্ষিক খরচ প্রায় ৩৪ কোটি পাউন্ড, যা সার্বভৌম অনুদানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
তবে কিছু কিছু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনে করে, পর্যটনের মাধ্যমে রাজতন্ত্র প্রতিবছর অর্থনীতিতে অবদান রাখে। এই খাত থেকে আসা অর্থ রাজপরিবারের নিরাপত্তা ও অন্যান্য খরচের তুলনায় অনেক বেশি।