পুতিনই কি প্রিগোশিনকে ক্রেমলিনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন
ইয়েভগেনি ভিক্টোরোভিচ প্রিগোশিন বা ওয়াই ভি প্রিগোশিন। স্পষ্টভাষী হিসেবে পরিচিত এই রুশ ধনকুবের ভাগনার নামে ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভাগনারের সেনারা রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই লড়াই করেছে। আফ্রিকায়ও মস্কোর স্বার্থে তারা কাজ করছে।
রাশিয়ার ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ইউক্রেনে যুদ্ধ চলাকালে রুশ সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে প্রিগোশিনের মতপার্থক্য দেখা দেয়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে সমালোচনার পর ভাগনার সেনাদের নিয়ে ক্রেমলিনের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে বসেন তিনি। ক্ষণস্থায়ী এই অভ্যুত্থানের দুই মাস পর ২৪ আগস্ট উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হলেন প্রিগোশিন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
প্রিগোশিনকে বহনকারী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে সব আরোহীর মৃত্যু হলেও কয়েক দিন বাদে তাঁর মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে ক্রেমলিন। প্রিগোশিনের মৃত্যুর পরদিন পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কথা মস্কো নিশ্চিত না করলেও প্রিগোশিনসহ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতিসমবেদনা জানান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
দীর্ঘদিন ক্রেমলিনের সঙ্গে সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রিগোশিনের। সরকারি অবকাঠামো ও খাবার সরবরাহের লোভনীয় চুক্তি পাওয়ার আশায় মূলত এ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। একই সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ভাগনার নামের আধা সামরিক এক বাহিনীও গড়ে তোলেন।
ক্রেমলিনের সঙ্গে এত সখ্যের পরও বহু বছর ধরে অনেকটা অন্তরালেই ছিলেন প্রিগোশিন। এমনকি মস্কোর পক্ষে সিরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভাগনারের সেনারা কার্যক্রম চালালেও তিনি এ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করতেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে রুশ বাহিনী। এর পর থেকে কিছুটা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন প্রিগোশিন। গত বছরের শেষ দিকে এসে প্রিগোশিন স্বীকার করেন, তিনিই ভাগনারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নেতৃত্বেই ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। চুক্তিভিত্তিক সেনা, কয়েদিসহ ভাগনারের সেনা রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার।
উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পরদিন এক ভাষণে পুতিন বলেন, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে প্রিগোশিনের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা। প্রিগোশিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে পুতিন প্রথমবারের মতো এসব কথা বলেন। কারণ, দীর্ঘদিন তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি রহস্যাবৃত ছিল। পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রিগোশিন অন্য রকম কথা বলেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেছিলেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এ শতকের শুরুতে।
টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া ওই ভাষণে পুতিন আরও বলেন, ‘আমি প্রিগোশিনকে দীর্ঘ সময় ধরে চিনি। সেই নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে। মানুষটির ভাগ্য খারাপ ছিল। জীবনে তিনি মারাত্মক কিছু ভুল করেছিলেন। তবে প্রয়োজনীয় কিছু লক্ষ্যও অর্জন করেছিলেন তিনি।’
বিগত কয়েক মাস ধরে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী এক ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রিগোশিন। তিনি এটা করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে, বিশেষত বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে।
রুশ সামরিক নেতৃত্ব যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, তা নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন প্রিগোশিন। প্রকাশ্যে এর কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যেত তাঁকে। সামরিক নেতৃত্বের এমন সমালোচনা করলেও প্রিগোশিনের বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন পুতিন। যদিও সরকারবিরোধী অন্যদের ওপর সমানেই দমনাভিযান চলছিল।
তবে ‘পুতিনের পাচক’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া প্রিগোশিনকে অবশ্য কখনোই সরাসরি পুতিনের সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। এদিকে পুতিনের তখনকার অবস্থান দেখে মনে হতো, এ ক্ষেত্রে তিনি বরং চাইতেন, সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা চলুক।
কিন্ত রুশ সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে প্রিগোশিনের এই মতপার্থক্য বেশি দিন প্রতিযোগিতার পর্যায়ে থাকেনি। গত ২৩ জুন ৩০ মিনিটের এক ভিডিও বার্তা দেন প্রিগোশিন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, ইউক্রেন সামরিক অভিযান ছিল মূলত অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায়ের একটা ফিকির। এর নেপথ্যে আছেন দুর্নীতিপরায়ণ একশ্রেণির অভিজাত। তাঁরা শুধু অর্থ আর বৈভবের পেছনে ছুটছেন। রাশিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই তাঁদের কাছে।
এই ভিডিও বার্তা দেওয়ার পর প্রিগোশিন সেদিন কী করেছিলেন, তা অনেকের জানা। এর কয়েক ঘণ্টা পর প্রিগোশিন অভিযোগ করেন, রুশ সেনারা ভাগনার সেনাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তিনি এর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেন এবং রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে ভাগনার সেনাদের মোতায়েন করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশিয়ার দক্ষিণে ইউক্রেন সীমান্তবর্তী শহর রোস্তভ-অন-দনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেন ভাগনারের সেনারা। তাঁরা মস্কোর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
ভাগনারের সেনারা মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে রাশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রিগোশিন ঘোষণা দেন, তিনি বিদ্রোহ থেকে সরে এসেছেন। রোস্তভ-অন-দন শহর থেকেও ভাগনার সেনা প্রত্যাহারে রাজি হন তিনি। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট ও পুতিনের মিত্র আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় মস্কোর সঙ্গে সমঝোতাও হয়।
সমঝোতা অনুযায়ী বিদ্রোহ করার জন্য প্রিগোশিন ও তাঁর প্রতি অনুগত ভাগনার সেনাদের বিচার করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয় মস্কো।একই সঙ্গে তাঁদের বেলারুশে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
ক্ষণস্থায়ী এই বিদ্রোহ ও পুতিনের পক্ষ থেকে ‘নিঃশর্ত’ ক্ষমা পাওয়ার পর একাধিক ভিডিও চিত্রে প্রিগোশিনকে দেখা গেছে। কখনো মনে হয়েছে, তিনি বেলারুশ কিংবা রাশিয়া, আবার কখনো আফ্রিকার কোনো দেশে অবস্থান করছেন। তবে এ সময়ে তাঁর সত্যিকার অবস্থান কখনোই জানা যায়নি।
ভাগনারের অস্তিত্বের বিষয়টি প্রথম জানা যায় ২০১৪ সালে। এ বছর ইউক্রেনে প্রথম সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। প্রিগোশিন রাশিয়ার পক্ষে একটি বেসরকারি সেনা গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জায়গা চান। কিন্ত ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে রাশিয়ার সরকারি সম্পৃক্ততা ছিল না। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে পশ্চিম ক্রাসনোদারে অঞ্চল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ আন্দেই সোলদাতভ। তিনি বলেন, প্রচলিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভাড়াটে সেনাদের মিশ্রণ ঘটানোর এ ব্যবস্থা রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক ছিল। কারণ, এতে বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার পেশাদার সৈনিক মোতায়েনের সুযোগ তৈরি হয়। এতে বিদেশে সামরিক তৎপরতা চালানো গেল, আবার তা অস্বীকার করার সুযোগও থাকল।
ভাগনারের প্রশিক্ষিত সেনারা ইউক্রেন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ পেল। এর পর থেকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, সুদান ও মোজাম্বিকে ভাগনারের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ তুলে এসেছে।
ভাগনারের এসব সামরিক তৎপরতা এত দিন গোপনেই চলছিল। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে অল্প দিনের মধ্যে কিয়েভ দখলের যে পরিকল্পনা করেছিল, তা বিফল হলে এর পর থেকে প্রিগোশিনের আধা সামরিক বাহিনী প্রকাশ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ভাগনারের জন্য যোদ্ধা নিয়োগ দিতে রাশিয়ার কারাগারগুলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রিগোশিন।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে উত্তর ইউক্রেনের বাখমুত শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। বাখমুত ছাড়াও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতে যেসব শহরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে, সেগুলোতে সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন ভাগনারের সেনারা।
বাখমুতসহ এসব শহরে লড়াইয়ের জন্য ভাগনার সেনাদের প্রশংসা করতে দেখা যায় প্রিগোশিনকে। ভাগনার সেনাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারাই সম্ভবত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী।’
ভাগনার সেনাদের প্রশংসার পাশাপাশি রুশ সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের কঠোর সমালোচনা করেন প্রিগোশিন। সেই সময় পরিচালিত একাধিক জনমত জরিপে দেখা যায়, প্রিগোশিন রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয়।
এ সময় প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও প্রকাশ করতেন প্রিগোশিন। এসব ভিডিওতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর নেতৃত্বের তীব্র ও কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যেত তাঁকে। প্রিগোশিন নিয়মিত যুদ্ধরত সেনাদের সঙ্গে যোগ দিতেন। সেখান থেকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সমালোচনা অব্যাহত রাখেন। দিন যত যায়, সমালোচনার ধার তত বাড়তে থাকে।
অনেকের ধারণা, প্রিগোশিনকে পুতিনই তৈরি করেছেন। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধের বিষয়টি দেখেও কিছু বলতেন না পুতিন। এমনকি শোইগুর সঙ্গে প্রিগোশিনের বিরোধ চলুক, সেই সুযোগও তিনি তৈরি করে দিতেন। কারণ, পুতিন তাঁর নিজের স্বার্থেই এমন প্রতিযোগিতা চলতে দিতেন।
অনুবাদ: আল-আমিন সজীব, সহসম্পাদক, প্রথম আলো