তুরস্কের এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলন কত দূর যেতে পারে

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র একরেমের সমর্থকদের বিক্ষোভ। ২৪ মার্চছবি: এএফপি

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রাতের আকাশে কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধ। তবু রাজপথ ছাড়ছেন না নগরের মেয়র একরেম ইমামোগলুর সমর্থক আন্দোলনকারীরা। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে আগেও কয়েকবার আন্দোলন হয়েছে। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নই মনে হচ্ছে। তুরস্কের দীর্ঘদিনের নেতার মধ্যে এবার কিছুটা অস্বস্তির আভাসও দেখা যাচ্ছে।

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্যতম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এমন পরিণতি শুধু তাঁর ক্ষেত্রে হয়েছে, এমন নয়। এরদোয়ান যাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন, তাঁদের তিনি নানাভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন। অতীতে এমনটি নানা সময় দেখা গেছে।

ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র কারাবন্দী একরেম ইমামোগলু বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতি নিয়ে তিনি আরও অনেক দূর যেতে পারেন।

মেয়রের বিরোধী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) একরেমের পক্ষ নিয়েছে। তাঁর সমর্থনে দলটি তাদের নেতা-কর্মীদের রাজপথে নামিয়ে এনেছে। তারাও আশা করছে, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হবে, পরিস্থিতি অনেক দূর গড়াবে।
একরেম ইমামোগলু সব সময় দক্ষতার সঙ্গে যেকোনো ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা বেশ ভালোভাবেই নিয়ে থাকেন। এমনকি তাঁকে গ্রেপ্তারের তোড়জোড় যখন চলছিল, তখনো তিনি তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এরদোয়ানের ওপর পরিস্থিতির ফায়দা বেশ ভালোভাবেই নিয়েছেন।

২০২৮ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একরেম ইমামোগলু ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের সমর্থন আদায় করেছেন। মুক্ত হলে তিনি যে এরদোয়ানের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হচ্ছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে এ ঘটনা শুধু এখানেই থেমে থাকবে না। ইস্তাম্বুলের মেয়রের ভাগ্যে আরও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। তিনি ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও সবকিছু যে তাঁর অনুকূলে যাবে, সেটা বলা যাচ্ছে না।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু
ছবি: রয়টার্স

এটা ঠিক, এরদোয়ানের জমানায় তুরস্কে মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্র ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অনেকে দেখছেন, পূর্ণমাত্রার স্বৈরতন্ত্র থামানোর জন্য এটি বড় এক সুযোগ। কিছুটা দেরি হলেও সবকিছু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

এরদোয়ানবিরোধী বিক্ষোভকারীরা দাঙ্গা পুলিশের বাধা আর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট উপেক্ষা করে প্রতি রাতে রাজপথে নেমে আসছে। শুধু কি তা–ই, রাজপথ, সেতু বন্ধ করে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। আছে আটক হওয়ার শঙ্কা। এত কিছুর মধ্যেই এরদোয়ানবিরোধীরা নেমে আসছেন রাজপথে।

গত পাঁচ দিনে এক হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে এবং প্রতিদিনই আটক করা হচ্ছে। এখানে বিরোধীদের কীভাবে গণহারে আটক করা হচ্ছে, তার একটি নমুনাও এসব ঘটনা।

তুরস্কের সরকার দাবি করে থাকে, দেশে গণতন্ত্র কার্যকর। দৃশ্যত যদি দেখা হয়, আসলে তা–ই। নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও বেশ ভালো। তুরস্কের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন, ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচন মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে হচ্ছে। এমনটাই দেখা যাচ্ছে।

তবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে যা ঘটছে, সেটাই হচ্ছে সমস্যা।

বিরোধী রাজনীতিকেরা গ্রেপ্তার হতে পারেন। সমালোচকদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। বিক্ষোভকারীরা গ্রেপ্তার হন। দেশের গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে সরকার–নিয়ন্ত্রিত। প্রেসিডেন্টকে ঠাট্টা করে কোনো টুইট করলে যে কারও জায়গা হতে পারে কারাগারের প্রকোষ্ঠে। নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে সরকারের পক্ষে প্রচারের সুনামি বয়ে যায়। অন্যদিকে বিরোধীদের ভোটারের কাছে পৌঁছানোর এমন কোনো সুযোগই থাকে না। তাঁদের মাঠে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়।

একরেম ইমামোগলু এমন একজন রাজনীতিক, যিনি সরকারের সব বাধা পেরিয়ে ভোটারের কাছে যেতে পারেন। তিনি বাস্তববাদী, গণমাধ্যম সম্পর্কে তার ভালোই কাণ্ডজ্ঞান রয়েছে। নিজের যোগ্যতায় তিনি তিন তিনবার ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ গ্রহণ এবং সন্ত্রাসী সংগঠন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।

এসব অভিযোগে একরেম দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর কারাদণ্ড হয়ে যেতে পারে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মানহানির অভিযোগে ইতিমধ্যে তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন। আপিলে কী রায় হবে, সেটা কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারে।