যেভাবে দেশে দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন স্বৈরশাসকের মেয়ে
এককালে পপ তারকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। করেছিলেন অলংকারের ব্যবসা। এমনকি কূটনীতিক হিসেবেও নাম লিখিয়েছিলেন। তিনি গুলনারা করিমোভা। উজবেকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক ইসলাম করিমভের মেয়ে।
গুলনারা করিমোভা এখন কারাগারে। তবে একসময় বিভিন্ন দেশে ২৪ কোটি ডলারের সম্পদ কিনেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের হিসাবে যা আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এসব সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছিল ঘুষ ও দুর্নীতির অর্থে। অস্ট্রিয়াভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ফ্রিডম অব ইউরেশিয়ার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ফ্রিডম অব ইউরেশিয়া বলছে, গুলনারা করিমোভার এই সম্পদ ছিল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন থেকে পূর্বে হংকং পর্যন্ত। এর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি ও একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ। সম্পদগুলো কেনা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে।
গুলনারা করিমোভা যুক্তরাজ্যের যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পদগুলো কিনেছিলেন, সেগুলোর হয়ে কাজ করেছিল লন্ডন ও করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসভিত্তিক কয়েকটি হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে নানা দেশের অপরাধীরা যুক্তরাজ্যের এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ দেশ থেকে অর্থ পাচার করছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
২০১৪ সালে গুলনারা করিমোভা সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে চলে যান। পরে জানা যায়, দুর্নীতির অভিযোগে তিনি আটক রয়েছেন। তখন কিন্তু তাঁরা বাবা ইসলাম করিমভ ক্ষমতায়। ২০১৭ সালে অভিযোগ প্রমাণিত হলে গুলনারা করিমোভাকে সাজা দেওয়া হয়।
ইসলাম করিমভ ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে বছরই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মেয়ে গুলনারা করিমোভা স্পেনে উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ধারণা করা হতো, ইসলাম করিমভের পর উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন গুলনারা করিমোভা।
তবে ২০১৪ সালে গুলনারা করিমোভা সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে চলে যান। পরে জানা যায়, দুর্নীতির অভিযোগে তিনি আটক রয়েছেন। তখন কিন্তু তাঁরা বাবা ইসলাম করিমভ ক্ষমতায়। ২০১৭ সালে অভিযোগ প্রমাণিত হলে গুলনারা করিমোভাকে সাজা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে গৃহবন্দী থাকার শর্ত না মানায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আইজীবীদের অভিযোগ ছিল, একটি অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন গুলনারা করিমোভা। ১২টি দেশে এই চক্রটি ১০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। গুলনারা করিমোভার দুর্নীতি নিয়ে ফ্রিডম অব ইউরেশিয়ার গবেষক টম মেনি বলেন, ইতিহাসে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি ঘটিয়েছেন উজবেকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্টের এই মেয়ে।
গুলনারা করিমোভার প্রেমিকের নাম রুস্তম মাদুমারভ। যুক্তরাজ্য, জিব্রাল্টার ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক হিসেবে নথিপত্রে নাম রয়েছে করিমোভার কয়েকজন সহযোগী ও রুস্তমের। তবে ফ্রিডম অব ইউরেশিয়া বলছে, করিমোভার পক্ষেই তাঁদের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক বানানো হয়েছে।
বাড়ি ও জমির মালিকানাসংক্রান্ত নানা নথিপত্র ঘেঁটে ফ্রিডম অব ইউরেশিয়া দেখতে পেয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সন্দেহজনক তহবিল ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে অন্তত ১৪টি সম্পদ কিনেছিলেন গুলনারা করিমোভা। এই সম্পদগুলো কেনা হয়েছিল যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যন্ড, ফ্রান্স, আরব আমিরাতের দুবাই, হংকংসহ বেশ কয়েকটি দেশে।
ইতিহাসে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি ঘটিয়েছেন উজবেকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্টের এই মেয়ে
ফ্রিডম অব ইউরেশিয়ার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে মঙ্গলবার (১৪ মার্চ)। সেখানে মূলত লন্ডনে গুলনারা করিমোভার কেনা পাঁচটি সম্পদের ওপরে আলোকপাত করা হয়েছে। বর্তমানে ওই সম্পদগুলোর মূল্য ৫ কোটি পাউন্ড। এর মধ্যে রয়েছে বাকিংহাম প্যালেসের পশ্চিমে বেলগ্রাভিয়া এলাকায় তিনটি ফ্ল্যাট, মেফেয়ার এলাকায় একটি বাড়ি এবং সারে এলাকায় ১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের বিশালাকার আরেকটি বাড়ি।
এর মধ্যে গুলনারা করিমোভা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১৩ সালে বেলগ্রাভিয়া এলাকার দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে ২০১৭ সালে বেলগ্রাভিয়ার আরেকটি ফ্ল্যাট এবং মেফেয়ার ও সারে এলাকার বাড়ি দুটি জব্দ করে যুক্তরাজ্য সরকার।
গুলনারা করিমোভার প্রেমিকের নাম রুস্তম মাদুমারভ। যুক্তরাজ্য, জিব্রাল্টার ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক হিসেবে নথিপত্রে নাম রয়েছে করিমোভার কয়েকজন সহযোগী ও রুস্তমের। তবে ফ্রিডম অব ইউরেশিয়া বলছে, করিমোভার পক্ষেই তাঁদের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক বানানো হয়েছিল।
গুলনারা করিমোভার সম্পদ কেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নাম—পেনালি লিমিটেড ও ওডেনটন ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। সম্পত্তি কিনতে এই প্রতিষ্ঠান দুটি খুলেছিল লন্ডনভিত্তিক এসএইচ ল্যান্ডার্স এলএলপি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। পরে ২০১০ সালের জুলাইয়ে এএইচ ল্যান্ডার্স আরেকটি নতুন প্রতিষ্ঠান কিনেছিল। এর উদ্দেশ্য ওই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করে রুস্তমের নামে একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ কেনা। আদতে ৪ কোটি ডলারের ওই উড়োজাহাজ কেনার পেছনে ছিলেন গুলনারা করিমোভা।
ওই উড়োজাহাজ কেনার জন্য রুস্তমের অর্থের উৎস কী ছিল, তা এসএইচ ল্যান্ডার্সের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ সম্পর্কে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক নয়।’ জবাব থেকে এটাই মনে হয়েছে, উড়োজাহাজটি কিনতে নিজের পকেট থেকে অর্থ দেননি রুস্তম।
এসএইচ ল্যান্ডার্স পরে অবশ্য জানায়, উড়োজাহাজ কিনতে রুস্তম যে অর্থ দিয়েছিলেন, তার একটা অংশ এসেছে উজবেকিস্তানের টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান উজদোনরোবিতা থেকে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গুলনারা করিমোভার সংযোগ নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। ২০০৪ সালে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম মস্কো টাইমস এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে অভিযোগ তোলা হয়, ভুয়া চালান ব্যবহার করে উজদোনরোবিতা থেকে প্রায় ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছিলেন গুলনারা।
এদিকে পেনালি লিমিটেডের ২০১২ সালের আর্থিক লেনদেনের একটি হিসাব দিয়েছিল এসএইচ ল্যান্ডার্স। সেখানে দেখা যায়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেন গায়ানে আভাকিয়ান নামে গুলনারা করিমোভার একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।
ফ্রিডম অব ইউরেশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদ কেনার ওই লেনদেনগুলো উচ্চপর্যায়ের লোকজন করেছিলেন। এই লেনদেন আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ঝুঁকি ছিল। তাই এসএইচ ল্যান্ডার্সের উচিত ছিল লেনদেনের অর্থের উৎস যাচাই করা। এটা নিশ্চিত করা যে ওই অর্থ বৈধ এবং অপরাধের মাধ্যমে উপার্জন করা হয়নি।
গুলনারা করিমোভার সম্পদ কেনা নিয়ে ফ্রিডম অব ইউরেশিয়ার টম মেনি বলেন, যেটা মনে হয়েছে করিমোভা সহজেই যুক্তরাজ্যে সম্পদ কিনতে পেরেছিলেন। বিষয়টা উদ্বেগের। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাজ্য সরকারের ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছিল। যদিও এর কয়েক বছর আগে অন্য অনেক দেশ তাঁর ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করতে পেরেছিল।