সাড়ম্বর অন্তিমযাত্রায় রানি এলিজাবেথ যুগের অবসান
সিংহাসনে আরোহণের অভিষেক অনুষ্ঠান বিশ্বে সর্বপ্রথম টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। গতকাল সোমবার তাঁর রাজকীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও সম্প্রচার হয়েছে সরাসরি, তবে অভিষেকের সম্প্রচার ছিল যুক্তরাজ্যের মধ্যে সীমিত, আর এবারে তা হয়েছে বিশ্বব্যাপী।
৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর পরদিন থেকে টানা ১০ দিনের জাতীয় শোক পালনের শেষে গতকাল তাঁকে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে ও রাজকীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে এলিজাবেথ যুগের যবনিকা ঘটল। ৭০ বছর আগে যে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাঁর অভিষেক, সেখানেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানও হয়েছিল একই গির্জায়।
এ সপ্তাহেই আটলান্টিকের অপর পারে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিলিত হওয়ার কথা বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের সরকারপ্রধানদের। কিন্তু তার আগেই শীর্ষ নেতাদের তার চেয়েও বড় এক সম্মিলনী ঘটে গেল রানি এলিজাবেথের প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে। বিশ্বে বর্তমানে যে ডজন তিনেক রাজতন্ত্র টিকে আছে, তাদের মধ্যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ অবস্থানের সাক্ষ্য রেখে গেল এ গাম্ভীর্যময় অথচ সাড়ম্বর শেষকৃত্য।
বর্তমান রাজতন্ত্রগুলোর প্রায় সব কটির প্রতিনিধিত্ব ছিল এ আয়োজনে, ছিলেন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর নেতারা। আরও ছিলেন বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীরা। যুক্তরাজ্যের কোমল কূটনীতিতে রাজপরিবারের প্রভাবেরও প্রমাণ পাওয়া গেল এসব শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে।
স্বাগতিক দেশের প্রটোকল মেনে তাঁরা তাঁদের নিত্যকার সুযোগ-সুবিধায় কিছুটা ছাড় দিলেন বিনা বাক্যে। হাতে গোনা ব্যতিক্রম, যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছাড়া এঁদের প্রায় সবাই পশ্চিম লন্ডনে নির্ধারিত স্থানে জড়ো হয়ে বাসে চেপে কোনো সহকারী ও নিজস্ব দেহরক্ষী ছাড়াই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রার্থনাসভায় যোগ দেন। রাষ্ট্রাচারে এ–ও এক নতুন সংযোজন।
রানির রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান ও বিদায় জানানোর আয়োজনটি একই সঙ্গে ছিল সামরিক ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ। কার্যত তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই একের পর এক যত আচার–অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছে, তার সবই হয় সামরিক, নয়তো ধর্মীয়। অনেক আয়োজন ছিল শত শত বছরের পুরোনো রাজকীয় রীতি অনুসরণে। আবার অনেক কিছুই হয়েছে আধুনিক যুগের প্রযুক্তি ও জীবনধারার সঙ্গে মিলিয়ে।
সর্বোচ্চ সংখ্যায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও মহড়ার কারণে। এমনকি গত কয়েক দিনে গভীর রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এর মহড়াও দিয়েছেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে একের পর এক বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে, যাতে কোনো ক্লান্তি বা একঘেয়েমির ছাপ দেখা যায়নি।
উইন্ডসর ক্যাসল, যাকে রানি তাঁর নিজস্ব আবাস বলে গণ্য করতেন, সেই দুর্গের প্রার্থনালয়ে তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের পাশেই তাঁকে সমাহিত করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দীর্ঘতম অধ্যায়গুলোর একটির ইতি ঘটবে।
রানি এলিজাবেথ রাজকার্যের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য যখন দ্রুত খর্ব হচ্ছিল। তাঁর জীবদ্দশায় সেই উপনিবেশের সীমানা আরও সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ পরিবর্তনগুলো দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছেন। যুদ্ধবিগ্রহ, বিশ্বরাজনীতিতে অস্থিরতা, প্রযুক্তির নাটকীয় অগ্রগতি, পারিবারিক সংকট—সবকিছুর মধ্যেই তিনি রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছেন।
রানি এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী রাজা তৃতীয় চার্লসের পালা শুরু হচ্ছে রানির সাফল্যের ছায়ায়। যুক্তরাজ্য ছাড়া রানি আর যে ১৫টি দেশ ও অঞ্চলের আলংকারিক প্রধান ছিলেন, তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ বা প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
সাবেক উপনিবেশগুলোর সঙ্গে একধরনের বন্ধনরক্ষায় রানি যে কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রাজা চার্লস সেই জোটকেও কতটা ধরে রাখতে পারবেন, তা-ও এক বড় প্রশ্ন। ঔপনিবেশিক আমলের নিষ্ঠুরতা, দাসত্ব, হত্যা ও লুণ্ঠনের যেসব অভিযোগ গত কয়েক বছরে নতুন করে সামনে আসছে, তা মোকাবিলার প্রশ্নও উপেক্ষণীয় নয়।
রানির রাজকীয় বিদায় যে আবহ তৈরি করেছে, তার রেশ হয়তো শিগগিরই মিলিয়ে যাবে না। কিন্তু এলিজাবেথ যুগের অবসানে সাবেক উপনিবেশগুলোর ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের দাবিও হারিয়ে যাবে না।