এক বছরের বেশি সময় আগে শুরু ইউক্রেন যুদ্ধ যেন অনেকটাই থমকে আছে। আগের তুলনায় রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অগ্রগতি বেশ কম। এখন মস্কোর আশঙ্কা, পশ্চিমা সহায়তায় পুষ্ট ইউক্রেন বাহিনী হয়তো রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে। এ হামলা ঠেকাতে ইতিমধ্যেই নানা তৎপরতা শুরু করেছে রুশ বাহিনী।
রাশিয়ার এই তৎপরতা মূলত প্রতিরক্ষামূলক। এর মধ্যে রয়েছে পরিখা খনন ও বাংকার নির্মাণসহ হামলা ঠেকানোর নানা ব্যবস্থা। উপগ্রহ থেকে ধারণ করা শতাধিক ছবিতে উঠে এসেছে এসব চিত্র। ছবিগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, গত অক্টোবর থেকে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা মোকাবিলার নানা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে রুশ বাহিনী।
স্যাটেলাইট ছবি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চার এলাকায় ইউক্রেন হামলা চালাতে পারে—এমন আশঙ্কায় সেখানে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে রাশিয়া। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের পশ্চিত তীর, ইউক্রেনের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের তোকমাক শহর, তোকমাকের পশ্চিমে ই–১৫০ মহাসড়ক এবং মারিউপোলের উত্তরে রিভনোপিল গ্রাম। দেখে নেওয়া যাক, রুশ বাহিনী সেখানে কী করছে।
ক্রিমিয়ার পশ্চিম তীর
২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়া দখল করে রেখেছে রাশিয়া। সমুদ্রসৈকতের জন্য পরিচিত এই উপদ্বীপটি। তবে সৈকতে এখন আর বিনোদনের কোনো চিহ্ন চোখে পড়বে না। বরং দেখা যাবে, উপকূলের ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষামূলক নানা অবকাঠামো। এগুলো তৈরি করেছে রুশ বাহিনী।
উপগ্রহ থেকে ধারণ করা একটি ছবিতে দেখা যায়, একটি সৈকত ঘেঁষে সারি বেঁধে রাখা হয়েছে পিরামিড আকৃতির ছোট ছোট কংক্রিটের ব্লক। ট্যাংক ও অন্যান্য সামরিক যানের পথ আটকাতেই এই ব্যবস্থা। এর পেছনেই একটু দূরে খোঁড়া হয়েছে পরিখা। পরিখা লাগোয়া অনেক বাংকার। প্রতিপক্ষের হামলা থেকে সুরক্ষা পেতে এই পরিখা ও বাংকার করা হয়েছে।
২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়া দখল করে রেখেছে রাশিয়া। সমুদ্রসৈকতের জন্য পরিচিত এই উপদ্বীপটি। তবে সৈকতগুলোতে এখন বিনোদনের কোনো চিহ্ন চোখে পড়বে না। বরং দেখা যাবে, উপকূলের ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষামূলক নানা অবকাঠামো।
কংক্রিটের ওই ব্লকগুলো ‘ড্রাগনস টিথ’ (ড্রাগনের দাঁত) নামে পরিচিত। সৈকতে সেগুলো জমা করে রাখতে দেখা গেছে। রয়েছে কাঠের স্তূপও। এ ছাড়া মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যবহৃত যানও দেখা গেছে। এর অর্থ, গত মার্চে যখন ছবিগুলো স্যাটেলাইট থেকে তোলা হয়েছিল, তখনো সেখানে কাজ চলছিল।
আগাম সতর্কতা হিসেবেই রাশিয়া এই প্রতিরক্ষমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকে। যেমন গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক লেলা গেস্ট। তিনি বলেন, ‘স্থলপথে নয়, বরং সমুদ্রপথে ক্রিমিয়ায় ইউক্রেনের হামলা ঠেকাতেই এই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
তবে এমন নয় যে শুধু ক্রিমিয়ার পশ্চিত তীরেই এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলে থাকা বিভিন্ন এলাকা, যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখভাগ, এমনকি রাশিয়া–ইউক্রেন সীমান্তজুড়েও পরিখা ও বাংকার নির্মাণের মতো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
তোকমাক
তোকমাক ইউক্রেনের ছোট একটি শহর। ইউক্রেনের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে এই শহরটির ওপর দিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। এই সড়কটি ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলে থাকা অন্য অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ক্রিমিয়াকে যুক্ত করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবে ইউক্রেন চাইবে, সড়কটি দখলে নিয়ে রুশ বাহিনীকে বিপত্তিতে ফেলতে।
এই শহর ঘিরে আগে থেকেই নানা কর্মযজ্ঞে নেমেছে রাশিয়া। খবর আছে, শহরটিকে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করতে সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখানে একটি ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারলে, রুশ বাহিনীর রসদ মজুতে কাজে লাগবে। যুদ্ধক্ষেত্রে বাহিনীর কোনো দল পিছু হটলে তারা এই ঘাঁটিতে আশ্রয়ও নিতে পারবে।
রাশিয়া হয়তো ইউক্রেন বাহিনীকে নির্দিষ্ট কিছু পথে আনতে চাইছে, যে পথগুলোয় ব্যাপকহারে মাইন স্থাপন করা রয়েছে এবং কামান তাগ করা রয়েছেআলেকজান্ডার লর্ড, সিবিলিন লিমিটেড
স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে দেখা গেছে, তোকমাক শহরের উত্তরে পরিখার একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এই দিক দিয়েই হামলা চালাতে পারে ইউক্রেন বাহিনী। পরিখার পাশাপাশি তোকমাক শহর ঘিরে গোল করে সাজানো হয়েছে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। শহর রক্ষায় রয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা।
তিন স্তরের নিরাপত্তার প্রথমেই রয়েছে খাদ। এর গভীরতা অন্তত আড়াই মিটার। কোনো ট্যাংক এই খাদ পার হতে গেলে যেন আটকা পড়ে, সেভাবেই এগুলোর নকশা করা। এরপরই রয়েছে কয়েক সারি ড্রাগন টিথ ও পরিখার আরেকটি নেটওয়ার্ক।
তবে এগুলোর পাশাপাশি ইউক্রেন বাহিনীর সামনে হয়তো আরও বাধা থাকবে। তোকমাক ঘিরে মাইন পুঁতে রাখার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক মার্ক কানসিয়ান।
এই গবেষক বলেন, ‘প্রতিটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত মাইন থাকে। আর পুরো যুদ্ধেই রুশ বাহিনী ব্যাপকহারে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করছে। এখানে (তোকমাক) সেগুলো আরও বেশি পরিমাণে আর ভালোভাবে লুকিয়ে রাখবে। কারণ, এর মাধ্যমে হামলাকারীদের গতি কমিয়ে দিতে পারলে কামান ও সেনাসদস্যদের মাধ্যমে তাদের ওপর হামলা করা যাবে।’
এদিকে স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে তোকমাকের কাছে আরও তিনটি শহরে একই ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেখা গেছে।
ই–১০৫ মহাসড়ক
তোকমাক শহরের পশ্চিমে রয়েছে ই–১০৫ মহাসড়ক। এই মহাসড়কটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত মেলিতোপোল শহরকে উত্তরের খারকিভ শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে মহাসড়কটি। খারকিভ বর্তমানে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই মহাসড়কটি যাদের থাকবে, তারা সহজেই পুরো অঞ্চলে চলাচল করতে পারবে।
তোকমাক শহরের পশ্চিমে রয়েছে ই-১০৫ মহাসড়ক। ইউক্রেনে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত মেলিতোপোল শহরকে উত্তরের খারকিভ শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে মহাসড়কটি। খারকিভ বর্তমানে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই যে বাহিনীর দখলে এই মহাসড়কটি থাকবে, তারা সহজেই পুরো অঞ্চলে চলাচল করতে পারবে।
ই–১০৫ মহাসড়কের পাশ দিয়ে ৩৫ কিলোমিটার ট্যাংকপ্রতিরোধী খাদ ও পরিখা গড়ে তুলেছে রুশ বাহিনী। এই খাদ ও পরিখার পেছনে মোতায়েন রয়েছে রাশিয়ার ভারী কামানগুলো। ইউক্রেন বাহিনী এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে চাইলে কামানগুলো দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালানো যাবে। কামানের আওতায় রয়েছে কাছের টি–৪০১ নামের আরেকটি সড়কও।
মার্ক কানসিয়ান বলেন, ‘সম্প্রতি ইউক্রেনের গড়ে তোলা সাঁজোয়া দলগুলো নিয়ে রাশিয়া শঙ্কিত। এসব দল প্রধান মহাসড়কে উঠতে পারলে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারবে। এই দলকে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং তাদের গতি কমিয়ে দেওয়াই রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য।’
রিভনোপিল গ্রাম
ক্রিমিয়া ও এর পূর্বে ইউক্রেনে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অবস্থিত মারিউপোল বন্দর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরের ৫৫ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে রিভনোপিল নামের ছোট একটি গ্রাম। স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে এই গ্রামের কাছে একাধিক গোলাকার পরিখা দেখা গেছে।
প্রতিটি পরিখার মাঝখানে রয়েছে মাটির স্তূপ। সেগুলো হয়তো কামানগুলোকে রক্ষা করতে অথবা স্থির রাখতে তৈরি করেছে রুশ বাহিনী। আর গোলাকৃতির পরিখাগুলো নিজেদের সুরক্ষায় ব্যবহার করতে পারবেন রুশ সেনারা। এ ছাড়া যেকোনো দিকে হামলা চালাতে কামানগুলো সরানোর কাজেও লাগবে।
তবে রাশিয়ার এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেক বিশ্লেষক। কারণ, ইউক্রেনীয় বাহিনীও স্যাটেলাইট ও ড্রোন থেকে ধারণ করা ছবি ব্যবহার করে রাশিয়ার এসব প্রস্তুতি চিহ্নিত করতে পারবে এবং সে অনুযায়ী পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিবিলিন লিমিটেডের আলেকজান্ডার লর্ড বলেন, রাশিয়া হয়তো ইউক্রেন বাহিনীকে নির্দিষ্ট কিছু পথে আনতে চাইছে, যে পথগুলোয় ব্যাপকহারে মাইন স্থাপন করা রয়েছে এবং কামান তাক করে রাখা রয়েছে।
তবে স্যাটেলাইট ছবিগুলোতে ধরা পড়া রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোই হয়তো সব নয়। এর বাইরেও আরও বহু এলাকায় রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মুখে পড়তে পারে ইউক্রেন বাহিনী। আর যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের এগিয়ে রাখতে আরও অনেক পরিকল্পনা থাকতে পারে রাশিয়ার।