লেটুসপাতা বেশি দিন টেকে, নাকি লিজ ট্রাসের প্রধানমন্ত্রিত্ব? বাজি ধরেছিল যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড পত্রিকা ডেইলি স্টার। যেদিন থেকে তারা বাজি ধরেছে, তারপর সাত দিনও পেরোল না। লিজ ট্রাস গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে মাত্র ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়লেন। অর্থনৈতিক নীতিতে তাড়াহুড়ো ও ভুল করার জন্য ক্ষমা চাওয়ার এক দিন পরই তাঁকে সরে যেতে হলো।
ইকোনমিস্ট সাময়িকী গত রোববারই বলেছিল, ট্রাস সম্ভবত যুক্তরাজ্যের স্বল্পতম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। ১৮২৭ সালে জর্জ ক্যানিং ১১৯ দিন ক্ষমতায় থেকে ওই রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন।
১৯৫ বছর পর নতুন রেকর্ডটি হলো বটে, তবে তাঁর দুর্বল নেতৃত্ব ও অদূরদর্শিতার জন্য ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ও যুক্তরাজ্যকে কড়া অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হচ্ছে। আর্থিক বাজারই কার্যত প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের পদত্যাগ অলঙ্ঘনীয় করে তুলল। অন্য কথায় বাজার অর্থনীতির নিষ্ঠুরতার বলি হলেন বাজারের ক্ষমতায় বিশ্বাসী লিজ ট্রাস।
ট্রাস নির্বাচিত হয়েছিলেন উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যকে চাঙা করা ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কর রেয়াত ও প্রণোদনার কর্মসূচির অঙ্গীকার করে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো ধরনের নীতিমালা ঘোষণা সম্ভব হয়নি। তারপর ছিল পার্লামেন্টের শরৎকালীন বিরতি, যা দলগুলোর বার্ষিক সম্মেলনের মৌসুম।
কিন্তু মাসখানেক আগে লিজ ট্রাসের নির্বাচনী নীতির আলোকে সাবেক অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টাঙ ছোট আকারের একটি বাজেট ঘোষণা করেন। ওই বাজেটে করপোরেশন কর কমানো, সবার জন্য প্রযোজ্য আয়করে ১ শতাংশ ছাড় এবং জাতীয় বিমার চাঁদা বাড়ানোর আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ব্যাংকারদের বোনাসের সীমা তুলে দেওয়া হয়।
এ বিপুল কর হ্রাসের কারণে সরকারের প্রতিশ্রুত খরচের জোগান আসবে কোত্থেকে, সেই প্রশ্নে আর্থিক বাজারে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। একদিকে পাউন্ডের মূল্য কমতে থাকে, অন্যদিকে সরকার ঋণ নিতে চাইলে তার জন্য প্রদেয় সুদের হার বাড়তে থাকে। বাজারের আস্থা ফিরে পেতে ট্রাস অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টাঙকে পদত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু বিশ্লেষকেরা একে স্বাভাবিক মনে করেননি।
পদত্যাগের বিবৃতিতে লিজ ট্রাস সাত দিনের মধ্যে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত হবেন বলে জানিয়েছেন। ঘোষিত নির্বাচনের সূচি অনুযায়ী আগামী সোমবার রাতেই জানা যেতে পারে কে হচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর কর্মসূচির জন্য অর্থমন্ত্রী বদল করে লিজ ট্রাস নিজের জন্য কিছুটা বাড়তি সময় আদায় করলেন বলে মন্তব্য করে কনজারভেটিভ সমর্থক পত্রিকা সানডে টাইমস। তখনই ডেইলি স্টার লেটুসপাতার সঙ্গে ট্রাসের ক্ষমতার স্থায়িত্বের তুলনা শুরু করে। লেটুস শুকিয়ে যাচ্ছে কি না, তা যাতে পাঠকেরা দেখতে পারেন, সে জন্য ইন্টারনেটে তা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রতিক্রিয়া হয় যুক্তরাজ্যের বাইরেও। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) খোলাখুলি ট্রাসের করছাড়ের নীতি বাতিলের আহ্বান জানায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনের সদস্য কোনো দেশকে এভাবে আইএমএফের সুপারিশ জানানো মোটেও স্বাভাবিক কিছু নয়। মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কোনো রাখঢাক না করে প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের নীতিকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেন।
লিজ ট্রাসের নতুন অর্থমন্ত্রী হন পার্টির নেতৃত্বের জন্য অতীতে বরিস জনসনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জেরেমি হান্ট। হান্ট কোয়াজি কোয়ার্টাঙের প্রায় সব করছাড়ের পদক্ষেপ বাতিল করে দেন। কনজারভেটিভ সমর্থক আরেকটি পত্রিকা সানডে টেলিগ্রাফ মন্তব্য করে, হান্টের পদক্ষেপের সাফল্য মানে হচ্ছে ট্রাসের ক্ষমতা কমে যাওয়া। দলীয় এমপিদের মধ্য থেকেই দাবি ওঠে, কার্যত ক্ষমতাহীন নামমাত্র প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে।
পদত্যাগের জন্য বিরোধী দলগুলো ও নিজ দলের বিদ্রোহীদের দাবির মুখে নিজেকে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না বলে ঘোষণা করার পরই অঘটন ঘটে দুটো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা বেভারম্যান মন্ত্রীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য পদত্যাগ করে যে বিবৃতি দেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের কড়া পরোক্ষ সমালোচনা উঠে আসে। আর রাতের বেলায় পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে দলীয় এমপিদের সঙ্গে হুইপ নিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া।
পদত্যাগের বিবৃতিতে লিজ ট্রাস সাত দিনের মধ্যে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত হবেন বলে জানিয়েছেন। ঘোষিত নির্বাচনের সূচি অনুযায়ী আগামী সোমবার রাতেই জানা যেতে পারে কে হচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। দলের পেছনের সারির এমপিদের ১৯২২ কমিটির সভাপতি স্যার গ্রাহাম ব্রাডির সঙ্গে বুধ ও বৃহস্পতিবার তাঁর দুই দফা বৈঠক হয়। কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অনলাইনে সাধারণ সদস্যদের ভোট নেওয়া হবে। যে বা যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের অন্তত ১০০ জন এমপির সমর্থন লাগবে। যাঁরা প্রার্থী হতে পারেন বলে নাম আসছে, তাঁরা হলেন ঋষি সুনাক, পেনি মরড্যান্ট, বেন ওয়ালেস।
লেবার পার্টিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো দাবি করছে সাধারণ নির্বাচন। জনমত জরিপে লেবার পার্টি কনজারভেটিভদের দ্বিগুণের বেশি ভোট পাবে বলে আভাস রয়েছে। এ অবস্থায় কনজারভেটিভ এমপিরা আসন হারানোর ভয়ে শঙ্কিত। তাই এখন নির্বাচন তাঁরা সমর্থন করবেন না বলেই মনে হয়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে দ্রুত মুক্তির পথ না পেলে নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে।
কনজারভেটিভ পার্টিতেও কেউ কেউ মনে করেন, জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা যত ব্যাপক, তা কারও পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আগামী এপ্রিলের পর ঠেকিয়ে রাখা না গেলে নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং গৃহঋণের সুদের হার বৃদ্ধির বোঝা সামাল দেওয়ার মতো দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জগুলো কোনো দুর্বল ম্যান্ডেটে যে সম্ভব হবে না, তা মোটামুটি স্পষ্ট।
সুতরাং অজনপ্রিয় কাজের দায়িত্ব লেবার পার্টির ঘাড়ে পড়লে তাঁরা কিছুটা ভারমুক্ত হতে পারবেন বলে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই মনে করেন। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দীর্ঘ ১২ বছরের কনজারভেটিভ শাসনের অবসান ঘটাতে লেবার পার্টি উন্মুখ হয়ে আছে। শিগগিরই আগাম নির্বাচন, তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।