ইতালির যে শহরে ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ

মনফালকোনে শহরের বাইরে ক্রিকেট অনুশীলন করতে হচ্ছে মিয়া বাপ্পির মতো ক্রিকেটপ্রেমীদেরছবি বিবিসির সৌজন্যে

ইতালির আদ্রিয়াটিক উপকূলে ছোট একটি জায়গায় প্রখর রোদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধু একসঙ্গে ক্রিকেট অনুশীলন করছিলেন। জায়গাটির অবস্থান ত্রিয়েস্তে বিমানবন্দরের কাছে মনফালকোনে শহরের উপকণ্ঠে। মনফালকোনের মূল শহরের ভেতরে খেলতে না পেরে তাঁরা এ জায়গা বেছে নিয়েছেন।

শহরের উপকণ্ঠে বাংলাদেশিদের যে দল ক্রিকেট অনুশীলন করছিল, সেই দলের অধিনায়ক মিয়া বাপ্পি। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যদি মনফালকোনের ভেতরে খেলতাম, পুলিশ এরই মধ্যে আমাদের থামাতে চলে আসত।’

মিয়া বাপ্পি একদল বাঙালি কিশোরকে দেখিয়ে বলেন, স্থানীয় পার্কে খেলার সময় তারা ‘ধরা’ পড়ে গিয়েছিল। তারা জানত না যে নিরাপত্তা ক্যামেরায় তাদের এ খেলার দৃশ্য ধারণ হচ্ছে। পুলিশ এসে তাদের খেলা ভন্ডুল করে দেয়। তাদের জরিমানা করা হয়।

মিয়া বাপ্পি আরও বলেন, ‘তারা (শহর কর্তৃপক্ষ) বলে, ইতালির জন্য ক্রিকেট নয়। তবে আমি আপনাদের সত্যিকারের কারণটা বলছি। তা হলো, আমরা বিদেশি।’

মনফালকোনে শহরটিতে ৩০ হাজারের কিছু বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বিদেশি। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশি মুসলিম। বড় বড় জাহাজ নির্মাণকাজে যুক্ত হতে ১৯৯০–এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশি মুসলিমরা শহরটিতে যাওয়া শুরু করেন।

মনফালকোনে শহরের মেয়র আন্না মারিয়া চিসিন্ত কট্টর ডানপন্থী লীগ দলের সদস্য। তাঁর মতে, সাংস্কৃতিকভাবে শহরটি ঝুঁকির মধ্যে আছে। অভিবাসনবিরোধী অনুভূতিকে পুঁজি করে ক্ষমতায় বসেছেন চিসিন্ত। নিজের শহর ও খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের ‘সুরক্ষা’ নিশ্চিতের লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজ করছেন।

চিসিন্ত বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এটা এখন আর কোনো বিষয়ই না। সবকিছু বাজেভাবে পাল্টে যাচ্ছে।’

মনফালকোনে শহরে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরা ইতালীয়রা সালোয়ার-কামিজ ও হিজাব পরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন। সেখানে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ আছে, হালাল খাবারের দোকান আছে। সেখানে সাইকেলের পথের যে লেন আছে, এর বেশির ভাগই দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ ব্যবহার করে।

চিসিন্ত দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তিনি শহরটির চত্বর থেকে বেঞ্চ সরিয়ে দিয়েছেন। এসব বেঞ্চে বাংলাদেশিরা বসত। সমুদ্রতীরে মুসলিম নারীরা যে ধরনের পোশাক পরেন, এরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।

চিসিন্ত বলেন, এখানে ইসলামি উগ্রপন্থার কঠোর একটি প্রক্রিয়া বিদ্যমান। এটি এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে নারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। নারীরা পুরুষদের দমন-পীড়নের শিকার হয়।

ক্রিকেট খেলায় নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই মেয়র দাবি করেন, নতুন একটি পিচ (ক্রিকেট খেলার জন্য) তৈরি করার মতো জায়গা বা অর্থ নেই। ক্রিকেট বলকেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন তিনি।

মেয়র চিসিন্ত বিবিসিকে বলেন, তিনি বাংলাদেশিদের তাদের প্রিয় খেলা ক্রিকেট খেলতে দিতে চান না। তাঁর দাবি, তাদের খেলার সুযোগ দিয়ে কোনো ফায়দা নেই।

চিসিন্ত বলেন, ‘তারা এ শহরকে কিছু দেয় না, আমাদের জনগোষ্ঠীকে কিছু দেয় না। ফল শূন্য। তারা মনফালকোনের বাইরে যেকোনো জায়গায় ইচ্ছেমতো যেতে পারে এবং ক্রিকেট খেলতে পারে।’

ফিনচ্যানতিয়েরি শিপইয়ার্ড ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপইয়ার্ড
ছবি বিবিসির সৌজন্যে

মুসলিমদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হত্যার হুমকিও পেয়েছেন মেয়র। এ কারণে তিনি এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশের সুরক্ষার মধ্যে আছেন।

ফিনচ্যানতিয়েরি শিপইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণের কাজ করার জন্য বাপ্পি ও তাঁর বন্ধুরা ইতালিতে এসেছেন। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিপইয়ার্ড।

মেয়র চিসিন্তের অভিযোগ, কোম্পানিটি বিদেশি শ্রমিকদের কম মজুরি দেয়। তাঁর মতে, বিদেশিদের এতটাই কম পারিশ্রমিক দেওয়া হয় যে কোনো ইতালীয় নাগরিক ওই বেতনে কাজ করতে রাজি হবেন না।

তবে শিপইয়ার্ডের পরিচালক ক্রিস্টিয়ানো বাজারা এ অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁর দাবি, ইতালীয় আইনের সঙ্গে সংগতি রেখেই বেতন দেওয়া হয়।

বাজারা বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা প্রশিক্ষিত কর্মী খুঁজে পাই না। ইউরোপে শিপইয়ার্ডে কাজ করতে আগ্রহী তরুণদের খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।’

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে জন্মহার সবচেয়ে কম। গত বছর ইতালিতে মাত্র ৩ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে।

ইতালিতে শ্রমিকদেরও ঘাটতি আছে। গবেষকদের হিসাব অনুসারে, ইতালিতে শ্রমিকের অভাব পূরণের জন্য ২০৫০ সাল পর্যন্ত বছরে ২ লাখ ৮০ হাজার বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন হবে।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী ও ব্রাদার্স অব ইতালি দলের নেত্রী জর্জিয়া মেলোনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের শ্রমিকদের ইতালিতে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি এর আগে বলেছেন, ইতালিতে অভিবাসনের হার তিনি কমাতে চান।

তবে মনফালকোনের মেয়র আনা মারিয়া চিসিন্ত মনে করেন, বাংলাদেশি মুসলিমদের জীবনযাত্রার ধরনের সঙ্গে স্থানীয় ইতালীয়দের জীবনযাত্রার কোনো মিল নেই।

মনফালকোনের মেয়র সেখানকার দুটি ইসলামি কেন্দ্রে জমায়েত করে প্রার্থনা নিষিদ্ধ করার পর থেকেই মূলত উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

এ ব্যাপারে মেয়র বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠিয়েছিল। সেখানে তিনি দেখেছেন, দুটি ইসলামি কেন্দ্রে অনেক মানুষ একত্র হয়ে প্রার্থনা করছে। মাত্র একটি ভবনে ১ হাজার ৯০০ জনের মানুষ জমায়েত হতেও দেখা গেছে। তিনি আরও বলেন, ইসলামি কেন্দ্রগুলো–সংলগ্ন ফুটপাতে অনেক বেশি বাইক রাখা হয়। সেখানে দিনে রাতে পাঁচবার উচ্চ স্বরে প্রার্থনা করা হয়।

মনফালকোনে শহরের মেয়র আন্না মারিয়া চিসিন্ত
ছবি বিবিসির সৌজন্যে

এতে স্থানীয় লোকজনের সমস্যা হয় বলে উল্লেখ করেন মেয়র চিসিন্ত। জমায়েত করে প্রার্থনা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তাঁর যুক্তি হলো, এটি নগর-পরিকল্পনার অন্তর্গত কোনো বিষয় নয়। ইসলামি কেন্দ্রগুলো ধর্মীয় প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। এর জন্য জায়গা করে দেওয়াটা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না বলেও দাবি করেন চিসিন্ত।

ইতালিতে সরকারিভাবে যে ১৩টি ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ইসলাম নেই। সে কারণে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রার্থনার জায়গা নির্মাণের চেষ্টা চালানোটা কঠিন।

মনফালকোনেতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বলেছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর মেয়রের সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

১৯ বছর বয়সী তরুণী মেহেলি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা ইতালিতে। তিনি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরেন ও খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতালির ভাষায় কথা বলেন।

মেহেলি বলেন, ‘মেয়র মনে করেন, বাংলাদেশিরা ইতালির ইসলামীকরণ করতে চায়; কিন্তু আমরা শুধু নিজেদের কাজটুকুই করছি।’

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে রাস্তায় তাঁকে হয়রানি সহ্য করতে হয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

শিপইয়ার্ডের কর্মী বাপ্পি তাঁর ইতালীয় পাসপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তবে তিনি মনফালকোনে থাকবেন কি না, তা নিশ্চিত নন।

বাপ্পি বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা তৈরি করি না। আমরা কর দিই; কিন্তু তারা আমাদের এখানে চায় না।’

বাপ্পি মনে করেন, তাঁরা যদি সবাই শহর ছেড়ে চলে যান, তবে শিপইয়ার্ডে একটি জাহাজ বানাতে পাঁচ বছর লেগে যাবে।

গ্রীষ্মে একটি আঞ্চলিক আদালত দুটি ইসলামিক কেন্দ্রের পক্ষে রায় দিয়েছেন। জমায়েত হয়ে প্রার্থনা নিষিদ্ধ করে শহর কর্তৃপক্ষ যে আদেশ দিয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।

তবুও মনফালকোনের মেয়র ‘ইউরোপে ইসলামীকরণ’–বিরোধী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন। তিনি সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে দ্রুত বার্তাটিকে ব্রাসেলসে পৌঁছে দেওয়ার মতো সুযোগ তাঁর তৈরি হয়েছে।