রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু হয়। চলতি শতকে এসে প্রথম সরাসরি যুদ্ধ দেখছে ইউরোপবাসী। ওই যুদ্ধের ছয় মাস হতে যাচ্ছে আগামী বুধবার। নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের পরও এখন পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ছয় মাসের যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ইউক্রেনীয় সেনা মাইকোলা (৪১) বলছিলেন, ‘ছয় মাসের এই যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের জন্য বড় দুর্দশার কারণ নয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্যই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা।’
ছয় মাসের এই যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের জন্য বড় দুর্দশার কারণ নয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্যই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মাইকোলাইভ শহরের সেনা হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন ৪০ বছর বয়সী চিকিৎসক ডক (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ রক্ত ঝরিয়েছে। আমাদের কান্নার কারণ হয়েছে। পুরো একটি প্রজন্মের ইতিহাস ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।’
একই কথা বললেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আরটেম। ৩০ বছর বয়সী এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা আমাদের সেনাদের জানিয়ে দিয়েছি এই যুদ্ধ বছরের পর বছর চলতে পারে। সেই অনুযায়ী তাঁদের মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।’
যুদ্ধের শুরুর দিকে অনেকেই বলেছিলেন, রুশ সেনারা দ্রুত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করে নেবে। ক্রেমলিনও কিয়েভ অভিমুখে বিশাল সেনাবহর পাঠায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিয়েভের পতন হয়নি। এখন কিয়েভের পরিবর্তে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দনবাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে মনোযোগ দিয়েছে রাশিয়া। সম্প্রতি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলেও হামলা জোরদার করেছে রুশ বাহিনী। পাল্টা হামলা চালাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারাও।
পরিস্থিতি বেশ জটিল। ইউক্রেনে শান্তির সম্ভাবনা এখনো সুস্পষ্ট নয়।
দক্ষিণাঞ্চলীয় মাইকোলাইভ শহরের পরিস্থিতি বেশ থমথমে। শহরজুড়ে যুদ্ধের ক্ষত ছড়িয়ে রয়েছে। যুদ্ধের শুরুর দিকে শহরটির প্রশাসনিক সদরদপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল রাশিয়া। এতে নিহত হয়েছিলেন ৩৭ জন। এরপর বিভিন্ন সময় হামলা ও পাল্টা হামলায় শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখনো শহরের চেকপয়েন্টগুলোয় বালুর বস্তা দিয়ে বানানো প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে।
স্থানীয় পেত্রো মোহাইলা ব্ল্যাক সি স্টেট ইউনিভার্সিটির রেক্টর লিওনিদ ক্লিমেনকো বলেন, ‘তারা (রুশ বাহিনী) বিদ্যালয়, হাসপাতাল, বন্দরসহ শহরের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে তারা ইউক্রেনের শিক্ষাব্যবস্থা, ইউক্রেনের মানুষের শক্তি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে চায়।’
তবে গত ছয় মাসে কিছু কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি আবারও শুরু করতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছেছে দুই পক্ষ। ইউক্রেন থেকে শস্য যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের সংকট ও বাড়তি দাম অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সম্প্রতি ইউক্রেন সফর করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সঙ্গে ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তবে তাঁদের এই সফরের মধ্যেও ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত মার্চের শুরু থেকে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। তবে ইউক্রেনীয় প্রযুক্তিবিদেরা এখন এটি রাশিয়ার নির্দেশে পরিচালনা করছেন।
ওই কেন্দ্রের কাছে লড়াই অব্যাহত রয়েছে এবং রাশিয়ার গোলার আঘাতে বেসামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাই বিশ্লেষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, জাপোরিঝিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ইউক্রেনে ও ইউরোপের সামনে চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। চেরনোবিলের মতো পারমাণবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন জানিয়েছেন, জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনে জাতিসংঘের একটি দলকে অনুমতি দেওয়া হবে।
এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধে আশার কথা শোনাতে পারছেন না আন্তোনিও গুতেরেসও। সম্প্রতি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী ওদেসা সফরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি বেশ জটিল। ইউক্রেনে শান্তির সম্ভাবনা এখনো সুস্পষ্ট নয়।’ গুতেরেসের মতে, ‘স্বল্প সময়ের মধ্যে শান্তি স্থাপনের টেকসই উপায় খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। তবে আমাদের অবশ্যই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, স্থিতিশীল বিশ্বের জন্য শান্তি অপরিহার্য।’