নতুন মার্কিন অস্ত্রে কি ধাক্কা খাবে রুশ বাহিনী
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে মোকাবিলায় যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমা মিত্রদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চাইছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। অবশেষে তাঁর ওই আহ্বানে সাড়া মিলেছে। ইউক্রেনে নতুন ধরনের দূরপাল্লার অস্ত্র পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অস্ত্রের নাম ‘গ্রাউন্ড লঞ্চড স্মল ডায়ামিটার বোম্ব’, সংক্ষেপে জিএলএসডিবি।
জিএলএসডিবি নিয়ন্ত্রণ করা হয় জিপিএসের মাধ্যমে। ফলে যেসব লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছানো কঠিন, সেগুলোও ধ্বংস করতে পারে এটি।
এর আগে ইউক্রেনে হিমার্স নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা পাঠিয়েছিল ওয়াশিংটন। এখন জিএলএসডিবি হাতে পেলে হিমার্সের চেয়ে দ্বিগুণ দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারবে ইউক্রেন বাহিনী। জিএলএসডিবি ১৫১ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। তাই বলা চলে, ইউক্রেনে অবস্থান করা রুশ বাহিনীকে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।
ইউক্রেনে এখন মূল যুদ্ধটা চলছে দেশটির পূর্বাঞ্চলে। জিএলএসডিবি পেলে এই অঞ্চলে রাশিয়ার অস্ত্র ও রসদের সংরক্ষণাগারগুলো ইউক্রেনের হামলার নাগালের মধ্যে চলে আসবে। এমনকি ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপেও হামলা চালাতে পারবে তারা। এতে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরও দূরে নিজেদের সংরক্ষণাগারগুলো সরিয়ে নিতে বাধ্য হতে পারে রাশিয়া। ফলে যুদ্ধরত রুশ সেনারা নাজুক অবস্থায় পড়বেন। পাশাপাশি নতুন কোনো হামলা চালানোও মস্কোর জন্য জটিল হয়ে পড়বে।
বাইডেন প্রশাসনের কাছে ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম বা এটিএসিএমএস’ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা চেয়েছিল ইউক্রেন। এটিএসিএমএস দিয়ে রকেট ছুড়ে ২৯৭ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়। তবে এখন পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা ইউক্রেনে পাঠানোর বিষয়ে রাজি হয়নি ওয়াশিংটন।
জিএলএসডিবি যুদ্ধে রুশ বাহিনীর তৎপরতা কমিয়ে দেবে বলে মনে করছেন ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরদনিয়াক। তিনি বলেন, হিমার্স যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। জিএলএসডিবি নামের এই রকেটগুলো আরও বেশি প্রভাব ফেলবে।
জিএলএসডিবি নিয়ন্ত্রণ করা হয় জিপিএসের মাধ্যমে। ফলে যেসব লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছানো কঠিন, সেগুলোও ধ্বংস করতে পারে এটি। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের বসন্তের শুরুর দিকে জিএলএসডিবি ইউক্রেনে পৌঁছাতে পারে। তবে হিমার্সের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা দিয়ে এই অস্ত্র ছোড়া যাবে না। তাই কিয়েভকে নতুন একধরনের রকেট উৎক্ষেপণব্যবস্থা সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ঝুঁকিতে পড়বে সরবরাহব্যবস্থা
গত বছরের জুনে ইউক্রেনে হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল ৭৭ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারে এমন রকেট। হিমার্সের মাধ্যমে ওই রকেটগুলো দিয়ে হামলা চালিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংরক্ষণাগার ধ্বংস করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি পায় কিয়েভ।
ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞ ওলেকসান্দ্র মুসিয়েঙ্কো বলেন, বর্তমানে ইউক্রেন ৮০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দূরে থাকা রুশ সামরিক স্থাপনাগুলোয় হামলা চালাতে পারে না। জিএলএসডিবি ব্যবহার করে যদি ক্রিমিয়ায় কিংবা রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত গড়ে তোলা এই স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা যায়, তাহলে রুশ বাহিনীর হামলার সক্ষমতা কমে যাবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেনের বেরদিয়ানস্ক ও মেলিতোপোল হয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছানোর সব পথও ইউক্রেন বাহিনীর হামলার নাগালের মধ্যে চলে আসবে। এতে করে ইউক্রেনে নিজ সেনাদের কাছে রসদ পৌঁছাতে বাধ্য হয়ে ক্রিমিয়া সেতু ব্যবহার করতে হবে রুশ ট্রাকগুলোকে। গত অক্টোবরে এক হামলায় এই সেতু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
মুসিয়েঙ্কো বলেন, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে একটি বড় সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখান থেকে সেনাদের ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে তারা। তাই ১৫০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানা যায়, এমন অস্ত্র পেলে ইউক্রেন ক্রিমিয়া সেতুতে হামলা চালাতে পারবে। ফলে ক্রিমিয়া থেকে ইউক্রেনে সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
এ ছাড়া ইউক্রেন দূরপাল্লার অস্ত্র পেলে তা রাশিয়ার মনোবলের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। তাঁদের একজন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অস্ত্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ টম কারাকো। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের হামলার নাগাল বাড়াতে এবং শত্রুপক্ষের হামলা নিয়ে রাশিয়াকে চিন্তার মধ্যে রাখতে কিয়েভকে জিএলএসডিবি দেওয়া সত্যিকার অর্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
আপাতত এটিএসিএমএস পাচ্ছে না ইউক্রেন
বাইডেন প্রশাসনের কাছে ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম বা এটিএসিএমএস’ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা চেয়েছিল ইউক্রেন। এটিএসিএমএস দিয়ে রকেট ছুড়ে ২৯৭ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়। তবে এখন পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণব্যবস্থা ইউক্রেনে পাঠানোর বিষয়ে রাজি হয়নি ওয়াশিংটন। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে করে যুদ্ধ আরও বেড়ে যেতে পারে।
এই এটিএসিএমএসের চেয়ে জিএলএসডিবি কম শক্তিশালী এবং কম ব্যয়বহুল। তবে জিএলএসডিবি আকারে তুলনামূলক ছোট এবং সহজে মোতায়েন করা যায়। এটা যুদ্ধে ইউক্রেন যেমনটি চাচ্ছে, সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন আপাতত চাচ্ছে রাশিয়ার হামলায় বাধা দিতে এবং কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকতে।
তবে ভবিষ্যতে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেন আরও বেশি পাল্লার অস্ত্র পেতে পারে বলে ধারণা করছেন অস্ত্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ টম কারাকো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল তারা একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অস্ত্রসহায়তা করবে। এখন তারা আরও শক্তিশালী অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে।
তবে আপাতত কত দ্রুত জিএলএসডিবি ইউক্রেনের হাতে তুলে দেওয়া হয়, সেটিই বড় বিষয় বলে মনে করছেন ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরদনিয়াক। তিনি বলেন, ‘যদি তারা (যুক্তরাষ্ট্র) এটি দ্রুত পাঠায়, তাহলে তা যুদ্ধক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।’