ইউক্রেনের হাতে পড়তে যাওয়া ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলাবারুদ কতটা ভয়ংকর
রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনকে বিপুলসংখ্যক অস্ত্রসহায়তা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এই সহায়তা এখনো চলছে। এরই মধ্যে কিয়েভের হাতে ‘ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ’ গোলাবারুদ তুলে দিতে চাচ্ছে যুক্তরাজ্য। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ করার সময় পাওয়া যায় এই ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম।
যুক্তরাজ্যের এই ঘোষণার পর চুপ নেই রাশিয়া। সঙ্গে সঙ্গে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পশ্চিমারা একত্র হয়ে এমন সব অস্ত্র ব্যবহার করছে, যেগুলোতে পারমাণবিক উপাদান রয়েছে। এর উপযুক্ত জবাব দেবে মস্কো।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, গোলাবারুদে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম থাকলে তা কতটা ভয়ংকর। গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরএএনডির পরমাণুবিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড গেইস্টের মতে, এ ধরনের অস্ত্রে কিছুটা তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকবে। তবে সেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের মতো বিক্রিয়া শুরু করে না।
গত শতকের সত্তরের দশকে সামরিক যানের সুরক্ষা বর্ম ভেদ করতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা বানানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বিমানবাহিনীর এ-১০ যুদ্ধবিমানেও এই ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা ব্যবহার করা হয়।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম কী?
পারমাণবিক জ্বালানি ও অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। এই সমৃদ্ধকরণ–প্রক্রিয়ায় বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম। এগুলো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশ কম শক্তিশালী। পারমাণবিক বিক্রিয়াও শুরু করতে পারে না।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এটি সিসার চেয়েও ঘন। এ কারণেই এই ইউরেনিয়াম গোলায় ব্যবহারের জন্য বেশ আকর্ষণীয়। আরএএনডির এডওয়ার্ড গেইস্ট বলেন, এটা এতই ঘন যে প্রচণ্ড গতিবেগ ধরে রাখতে পারে। ফলে এটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানে সুরক্ষার জন্য যে বর্ম ব্যবহার করা হয়, তা ভেদ করে যেতে পারে। আর এটা এত গরম হয় যে আগুন ধরে যায়।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের টি-৭২ ট্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ২০০৩ সালে আবার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে এই গোলা ব্যবহার করা হয়।
গত শতকের সত্তরের দশকে সামরিক যানের সুরক্ষা বর্ম ভেদ করতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা বানানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই দেশটির ট্যাংকগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে সেগুলোতে এই গোলা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া মার্কিন বিমানবাহিনীর এ–১০ যুদ্ধবিমানেও এই ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা ব্যবহার করা হয়।
এ ধরনের অস্ত্রে কিছুটা তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকবে। তবে সেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের মতো বিক্রিয়া শুরু করে না
রাশিয়া কী বলছে?
ইউক্রেনে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা সরবরাহের ঘোষণার পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, যুক্তরাজ্য তাদের সহনশীলতা হারিয়ে ফেলেছে। এই গোলাবারুদ সরবরাহ করা হলে তা হবে যুদ্ধ আরও তীব্রতর করার একটি পদক্ষেপ।
এ নিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু বলেছেন, ‘এই ঘোষণা (পশ্চিমাদের) আরেকটি পদক্ষেপ। তবে তাদের এ ধরনের পদক্ষেপের সংখ্যা কমে আসছে।’ আর পুতিন বলেছেন, যুক্তরাজ্য এই গোলাবারুদ দিলে ‘জবাব দিতে বাধ্য হবে’ রাশিয়া।
যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জন কিরবির ভাষ্যমতে, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলার ট্যাংকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা আছে। তবে এগুলো তেজস্ক্রিয় নয়। আর গোলাবারুদগুলো কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্রের কাছাকাছি নয়।
গোলাগুলো নিয়ে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে এই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি সাধারণ একটি অস্ত্র। রাশিয়া যদি তাদের ট্যাংক ও ট্যাংকের সেনাদের নিয়ে আলাদাভাবে উদ্বিগ্ন হয়, তাহলে তারা সেগুলোকে সীমান্ত পার করে রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’
বর্তমানে এই অস্ত্রের ব্যবহার হলে প্রথম শিকার হবে ইউরোপের দেশগুলোইভিয়াচেস্লাভ ভলোদিন, রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার
বোমা নয়, তবুও আছে ঝুঁকি
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম হলো হেভি মেটাল বা ভারী ধাতু। এ দিয়ে তৈরি গোলা ‘রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয়তার দিক দিয়ে বিষাক্ত’।
যদিও ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি গোলাকে পারমাণবিক অস্ত্র হিসেবে ধরা হয় না, তবে এগুলো অল্প মাত্রায় হলেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। এ কারণে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এই গোলা নিয়ে কাজ করার সময় সতর্কতা মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছে।
আইএইএর সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছে, এই গোলাগুলো যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া এগুলো নিয়ে কাজ করার সময় গ্লাভসসহ নানা সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। আর প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে, তাঁরা যেন এই গোলাগুলো এড়িয়ে চলে।
জাতিসংঘের এই সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম প্রধানত বিষাক্ত রাসায়নিক। এর কণাগুলো খাবার ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যদিও এই কণার বেশির ভাগই মলমূত্রের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু রক্তে মিশে যায়, আর কিডনি নষ্ট করে দিতে পারে।
কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে এই গোলা?
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ গোলা ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের টি–৭২ ট্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ২০০৩ সালে আবার দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে এই গোলা ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সার্বিয়া ও কসোভোয় ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা ব্যবহার করা হয়েছে। ওই যুদ্ধগুলোয় অংশ নেওয়া অনেক মার্কিন সেনা একটা প্রশ্ন তুলেছেন যে বর্তমানে তাঁদের অসুস্থতার কারণ ওই গোলাগুলো কি না।
এ নিয়ে রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার ভিয়াচেস্লাভ ভলোদিন বলেন, সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও ইরাকে যুদ্ধের সময় এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে সেখানে ব্যাপক হারে ক্যানসার বেড়েছে। আর বর্তমানে এই অস্ত্রের ব্যবহার হলে প্রথম শিকার হবে ইউরোপের দেশগুলোই।