রাশিয়ার অঞ্চল দখলের মাধ্যমে কী করতে চাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী
দিন কয়েক আগের এক সকাল। রাশিয়ায় ইউক্রেনের দখল করা একটি এলাকায় গাড়িতে চড়ে বসেন তিনজন। তাঁরা ইউক্রেন বাহিনীর বিশেষ একটি দলের সদস্য। ওই গাড়ির পেছনের কাচ ভাঙা। এর আগের দিনই রাশিয়ার ড্রোন থেকে ফেলা বোমার আঘাতে ওই হাল হয় গাড়িটির। গাড়িতে উঠে ইউক্রেনের দিকে ছুটে চলেন তাঁরা।
ছয় ঘণ্টা বাদেই ওই সেনাদের রাজধানী কিয়েভে পৌঁছানোর কথা। গাড়িতে তাঁদের সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি বাক্সে ভরা বহুমূল্য সব নথিপত্র। শত্রুদেশ রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের সুদঝা শহর এবং পরিত্যক্ত নানা পরিখায় চার দিন অভিযান চালিয়ে জোগাড় করেছেন সেগুলো। নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে রুশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র।
কুরস্ক অঞ্চলে চার সপ্তাহ ধরে অভিযান চালিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী। দখল করে নিয়েছে বড় একটি অংশ। এ অভিযান মস্কোকে এক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইউক্রেনের দখল করা অঞ্চলগুলোয় বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন থেকে রুশ পতাকা নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় ইউক্রেনের সেনাদের টহলের সময় রুশ নাগরিকদের নিরাপদে আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে।
ইউক্রেনের এ অভিযান নিয়ে গোপনে পরিকল্পনা করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাতে খুব কম মানুষকেই যুক্ত করেছিলেন তিনি।
ইউক্রেনের এ অভিযান নিয়ে গোপনে পরিকল্পনা করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাতে খুব কম মানুষকেই যুক্ত করেছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক বলেছিলেন, ‘এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত হওয়া অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো অভিযান সম্পর্কে যত কম মানুষ জানবে, সেটি তত বেশি সফল হবে। এ অভিযান সম্পর্কে খুব কম মানুষ জানতেন।’
রাশিয়ার কুরস্কে অভিযানের কয়েক সপ্তাহ আগেই সীমান্তবর্তী ইউক্রেনের সুমি শহর ও এর আশপাশের এলাকায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখেছিলেন স্থানীয় লোকজন। ওই সেনা সদস্যদেরও অভিযান সম্পর্কে আগে থেকে জানানো হয়নি। অভিযানে অংশ নেওয়া এক সেনা সদস্য বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, রাশিয়ার সম্ভাব্য কোনো হামলা ঠেকাতেই আমাদের সুমিতে আনা হয়েছে।’
এদিকে কুরস্কে অভিযান যখন ইউক্রেনীয়দের মধ্যে মনোবল বাড়াচ্ছে, তখন দেশটির অনেক সেনাই একটি বিষয় নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।
ইউক্রেনের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে দাবি করা হয়েছে, তারা কুরস্কের প্রায় ১ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এ এলাকায় বেশির ভাগই গ্রাম। তবে সুদঝা শহরও রয়েছে। ইউক্রেনে অভিযান শুরুর আগে এ শহরে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। অনেকেই চলে গেছেন। যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁদের আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ ও মুঠোফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন।
সুদঝা শহর এখন পুরোপুরি ইউক্রেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানের বিভিন্ন ভবন ও দোকান থেকে রুশ পতাকা, পোস্টার ও পুতিনের ছবিযুক্ত টি-শার্ট জব্দ করছেন ইউক্রেনের সেনারা। তাঁদের একজন হাসতে হাসতে বলেন, ‘এখানের বাসিন্দাদের বলেছি, আমরা কুরস্ক শহর দখল করেছি এবং মস্কোর দিকে এগোচ্ছি। আপনাদের ইউক্রেনীয় ভাষা শেখার সময় এসেছে।’
আপাতত রাশিয়ায় ইউক্রেনের অভিযান থেমে রয়েছে। প্রতিপক্ষের হাত থেকে নিজেদের ভূখণ্ড এখনো ফিরিয়ে নিতে পারেনি রুশ বাহিনী। কিয়েভ জানিয়েছে, তাদের দখলে থাকা রুশ অঞ্চল ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই। তবে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকবে।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক বলেন, ‘আমরা রাশিয়া নই। এই অঞ্চলগুলো নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে আমাদের সংবিধান পুনর্লিখন চাই না। আমাদের কাজ হলো রুশ কামানসহ হামলার কাজে ব্যবহৃত সামরিক সরঞ্জামগুলো আরও পিছু হটিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া রাশিয়ার অস্ত্রাগার ও সামরিক অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করা। রাশিয়ার নাগরিকদের জনমতের ওপরও প্রভাব ফেলতে চাই আমরা।’
কিয়েভের অনেকে এটাও মনে করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার জন্য মস্কোকে চাপ দেওয়া এই অভিযানের আরেকটি লক্ষ্য। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাক্ষাৎকারে প্রথমে এড়িয়ে গিয়েছিলেন পোদোলিয়াক। তবে পরে বলেন, ‘রাশিয়াকে আলোচনার জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে। তবে এর জন্য কুরস্কের মতো অভিযান লাগবে।’
ইউক্রেনের আরেকটি লক্ষ্য হতে পারে রুশ সেনাদের বন্দী করা। তারপর তাঁদের বিনিময়ে রাশিয়ার কারাগারে বন্দী থাকা হাজারো ইউক্রেনীয়দের মুক্ত করা। কিয়েভের দাবি, কুরস্ক অঞ্চল থেকে তারা প্রায় ৬০০ রুশ সেনাকে বন্দী করেছে। সপ্তাহখানেক আগেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে ১১৫ জন বন্দী বিনিময় হয়েছে।
এদিকে কুরস্কে অভিযান যখন ইউক্রেনীয়দের মধ্যে মনোবল বাড়াচ্ছে, তখন দেশটির অনেক সেনাই একটি বিষয় নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। সেটি হলো ইউক্রনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি থামানো যাচ্ছে না। তারা ধীরে ধীরে ইউক্রেনের পোকরোভস্ক শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে। যদি এই অগ্রগতি চলতে থাকে, তখন কুরস্ক অভিযানে ইউক্রেনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন বাড়তে পারে।
ইউক্রেনের এক সেনা সদস্য বলেন, ‘আপাতত এই অভিযান যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের সফলতার একটি প্রতীক। এ অভিযানের মাধ্যমে আমরা সীমান্তে মুক্ত অঞ্চল তৈরি করতে পারি। ফলে আমাদের ওপর হামলা কমবে। অন্তত রুশ সেনাদের আটক করে বন্দিবিনিময় করতে পারি। এতে আমাদের দেশের মানুষ খুশি থাকার মতো কোনো একটা উপলক্ষ পাবে।’