রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ ২০২৪ সালে তৃতীয় বছরে পড়তে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীর বসন্ত অভিযান আশানুরূপ সাফল্য পায়নি। ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ এলাকা এখনো রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
গত কয়েক মাসে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে একটা প্রশ্ন সামনে এসেছে। তা হলো ২০২৪ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিবিসির পক্ষ থেকে তিনজন সমর বিশেষজ্ঞের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যাবে, এমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। কেননা গত বছরের এই সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যতটা শক্তিশালী ছিলেন, এখন তাঁর শক্তি আরও বেড়েছে। এক বছরে পুতিন সামরিকের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে বেশি শক্তিশালী হয়েছেন।
যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল চলবে না
বারবারা জ্যানচেত্তা কিংস কলেজ অব লন্ডনের ওয়ার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক। বারবারার মতে, ইউক্রেনে যুদ্ধ চলবে। কিন্তু তা অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়।
বারবারা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যাবে, এমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। কেননা গত বছরের এই সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যতটা শক্তিশালী ছিলেন, এখন তাঁর শক্তি আরও বেড়েছে। এক বছরে পুতিন সামরিকের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে বেশি শক্তিশালী হয়েছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে এখনো অনিশ্চিত পরিস্থিতি রয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর শীতকালীন অভিযান থেমে গেছে বলেই মনে হচ্ছে; যদিও রুশ বাহিনীর বড় কোনো সাফল্য আপাতত নেই। এর চেয়ে বরং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে বসে (বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে) নেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো মুখ্য হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ ঐক্য দেখা গিয়েছিল। ২০২৩ সালেও এই ঐক্য আমরা দেখেছি। কিন্তু সম্প্রতি তা ফিকে হতে শুরু করেছে।
ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত প্রতিরক্ষা সহায়তা প্যাকেজগুলো মার্কিন কংগ্রেসে বাধার মুখে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওয়াশিংটনে একে ‘সংকীর্ণ রাজনীতি’ বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে ইউক্রেনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড় দেওয়া না দেওয়া হাঙ্গেরির অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর এমন দ্বিধান্বিত পদক্ষেপ কার্যত পুতিনকে উৎসাহিত করছে। তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশ্য উপস্থিতি ও বেপরোয়া বিবৃতি সেটার প্রমাণ। এখন প্রশ্ন হলো, পুতিন ও তাঁর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছুর বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়ার শক্তি ও দৃঢ়তা পশ্চিমারা দেখাতে পারবে কি না?
ইউক্রেন ও মলদোভাকে ইইউর সদস্য করার জন্য আলোচনার পথ খুলছে। এটা শুধু প্রতীকী কোনো উদ্যোগ নয়। এর মধ্য দিয়ে কিয়েভকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে চায় ইইউ। আর এমনটা হলে ইউক্রেনে রাশিয়ার চূড়ান্ত বিজয় অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আর নতুন বছরে ইউক্রেন নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট থাকার সময় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিতে নানা হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু শেষ অবধি ২০১৬ সালে এমন কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। তা ছাড়া ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ৭৫ বছরের পুরোনো ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্কে ছেদ ঘটাতে তিনি এককভাবে বিপ্লবী কোনো উদ্যোগ নিতে পারবেন না।
পশ্চিমা শিবিরের সাম্প্রতিক ফাটল যে অর্থহীন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটা বলাই যায়, পশ্চিম ও ইউক্রেনের জন্য ২০২৪ সাল বেশ কঠিন একটি বছর হবে। বছরজুড়ে ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে পারে। তবে তা অনির্দিষ্টকাল ধরে নয়।
যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনের আভদিভকায়। বোমা পড়ছে দেশটির তোকমাকে ও ক্রামাতোরস্কে। সম্মুখসমরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে এসব জায়গা। কিন্তু নতুন বছরে এ যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারিত হতে পারে মস্কো, কিয়েভ ছাড়াও ব্রাসেলস, ওয়াশিংটন, বেইজিং, তেহরান ও পিয়ংইয়ং থেকে।
যুদ্ধের গতি যাবে অন্যদিকে
লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক মাইকেল ক্লার্কের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। কেননা ২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযান ইউরোপের ভূখণ্ডে বড় যুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। ২০২৩ সালজুড়ে চলা যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়েছে, ইউরোপ মহাদেশে শিল্প যুগের যুদ্ধ পরিস্থিতি ফিরে এসেছে।
শিল্পযুগের যুদ্ধ পরিস্থিতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ওই সময় অনেক ক্ষেত্রেই যুদ্ধ উপকরণ তৈরিকে ঘিরে পুরো অর্থনীতির চাকা ঘুরেছিল। এটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। তেমনভাবেই ২০২১ সালের পর থেকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেট তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। নতুন বছরে তা রুশ সরকারের মোট বার্ষিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশ হবে।
এখন দেখার বিষয়, শিল্পযুগের যুদ্ধ পরিস্থিতির এ চাহিদা নতুন বছরে রাশিয়া (উত্তর কোরিয়া, ইরানসহ রুশ মিত্ররা) ও কিয়েভের পশ্চিমা মিত্ররা কতটা সামাল দিতে পারে। তবে তা যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলবে।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধের সক্ষমতা অচল হয়ে পড়েছে, এটা বললে ভুল হবে। বরং উভয় পক্ষই কৌশলগতভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। নতুন বছরে রুশ বাহিনী সম্মুখসমরে বড় ধাক্কা দিতে পারে। বিশেষ করে দনবাস অঞ্চলের পুরোটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করবে রাশিয়া।
অন্যদিকে রুশ বাহিনীর এমন আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করতে চাইবে ইউক্রেন। সেই সঙ্গে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিমাঞ্চল ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ বসফরাস প্রণালিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করবে কিয়েভ। কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রুশ বাহিনীর সামনে ইউক্রেনের সামরিক চমক দেখানোর সম্ভাবনাও রয়েছে।
তবে বলা যায়, ইউক্রেন ও রাশিয়া—দুই পক্ষের জন্যই ২০২৪ সাল হতে পারে একত্রীকরণের বছর।
আগামী গ্রীষ্মের শুরুতে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার শুরু করবে ইউক্রেনীয় বাহিনী। নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি এটা উন্নত রুশ যুদ্ধবিমানগুলোকে মোকাবিলায় ইউক্রেনের সক্ষমতা বাড়াতেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
২০২৫ সালের বসন্ত পর্যন্ত কৌশলগত যুদ্ধ চালাতে প্রয়োজনীয় সামরিক উপকরণ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে রাশিয়ার। অন্যদিকে নতুন বছরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেনের পশ্চিমা সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন হবে।
যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনের আভদিভকায়। বোমা পড়ছে দেশটির তোকমাকে, ক্রামাতোরস্কে। সম্মুখসমরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে এসব জায়গা। কিন্তু নতুন বছরে এই যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারিত হতে পারে মস্কো, কিয়েভ ছাড়াও ব্রাসেলস, ওয়াশিংটন, বেইজিং, তেহরান ও পিয়ংইয়ং থেকে।
মার্কিন যুদ্ধবিমানের প্রভাব
২০২৪ সালে সম্মুখসমরে ইউক্রেন ও রুশ বাহিনীর মধ্যে তফাত গড়ে দিতে পারে মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান—এমনটাই মনে করছেন বেন হজেস। তিনি ইউরোপে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাবেক কমান্ডিং জেনারেল।
বেন হজেসের মতে, ইউক্রেনকে পরাস্ত করতে যুগান্তকারী সক্ষমতার অভাব রয়েছে রাশিয়ার। তাই এখন যেসব এলাকা রুশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, ২০২৪ সালে তা ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকবে মস্কো। একই সঙ্গে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সময়টা কাজে লাগাবে রাশিয়া। আরেকটি জিনিস ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা করতে পারেন। তা হলো ইউক্রেনের প্রতি তার পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ফুরিয়ে আসার প্রত্যাশা করা।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, তবে ইউক্রেন থামবে না। কেননা দেশটি টিকে থাকার জন্য লড়ছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা ভালোমতো জানেন, তাঁরা থেমে গেলে রাশিয়া কী করতে পারে। তাই ইউরোপের অনেক দেশ এখন ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরব হয়েছে; যদিও গুঞ্জন রয়েছে, ইউক্রেনের বিষয়ে নিজেদের সংকল্পে দুর্বল হয়ে পড়েছে ওয়াশিংটন।
তবে আমার প্রত্যাশা, ২০২৪ সালের শুরুর দিকেই মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেন নিয়ে তাঁর হারানো ‘কৌশলগত মেরুদণ্ড’ পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে চলতি ডিসেম্বরে মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার যে বিল আটকে দিয়েছে, তা দ্রুত পাস করা হবে—এমনটাই বললেন বেন হজেস।
বেন হজেসের মতে, আগামী কয়েক মাসে ইউক্রেন চারটি জিনিস করতে পারে। প্রথমত, মাসের পর মাস যুদ্ধের জেরে জীর্ণ হয়ে যাওয়া সেনা ইউনিটগুলো পুনর্গঠন করা। নতুন করে আক্রমণের জন্য এসব ইউনিট প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, সক্ষম জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রক্রিয়া উন্নত করা। তৃতীয়ত, গোলাবারুদ ও অস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানো। সবশেষে রাশিয়ার শক্তিশালী ইলেকট্রনিক যুদ্ধ–সক্ষমতার বিপরীতে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া।
আগামী গ্রীষ্মের শুরুতে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার শুরু করবে ইউক্রেনীয় বাহিনী। নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি এটা উন্নত রুশ যুদ্ধবিমানগুলোকে মোকাবিলায় ইউক্রেনের সক্ষমতা বাড়াতেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বেন হজেস।
ক্রিমিয়া ইউক্রেনের সবচেয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জায়গাটি রাশিয়ার দখলে রয়েছে। সেভাস্তোপোলে রুশ নৌঘাঁটি, জানকোয়েতে বিমানঘাঁটি ও রসদ সরবরাহের ঘাঁটি থাকায় ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ মস্কোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেন হজেস বলেন, নতুন বছরে ক্রিমিয়া নিয়ে মস্কোর ওপর চাপ বজায় রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে ইউক্রেন।
ইউক্রেনের হাতে সীমাহীন সম্পদ নেই, বিশেষ করে গোলাবারুদ আর দূরপাল্লার নির্ভুল অস্ত্র রয়েছে সামান্যই। রুশ বাহিনীর অবস্থাও খুব ভালো নয়। বেন হজেসের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইচ্ছার পরীক্ষা দিতে হয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও রসদের (লজিস্টিক) সরবরাহ পেতে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সরবরাহব্যবস্থা ভঙ্গুর। সেই সঙ্গে তা ইউক্রেনের ক্রমাগত চাপের মুখে রয়েছে।