লরি নাকি সামুদ্রিক ড্রোন, কার্চ সেতুতে বিস্ফোরণের পেছনে কী
মস্কোর দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়াকে যুক্ত করা কার্চ সেতুতে গত শনিবার ভয়াবহ এক হামলা হয়েছে। বিস্ফোরণে সেতুর একটি অংশ ধসে পড়ে। এতে আংশিক যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এই হামলা ইউক্রেন করেছে বলে দাবি ক্রেমলিনের। কিন্তু হামলাটি কীভাবে হয়েছে, সেই বিষয় এখনো স্পষ্ট নয়।
হামলা বা বিস্ফোরণ নিয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর একটিও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। হামলার পরপরই রাশিয়া দ্রুততার সঙ্গে জানায়, একটি লরিতে বিস্ফোরক রাখা ছিল। বিস্ফোরকবোঝাই লরিটি সেতু পারাপারের সময় তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। তবে রাশিয়া অবশ্য এটা বলেনি, কে বা কারা হামলা করেছে।
হামলার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছেন, এটি একটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ইতিমধ্যে এ হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার ইঙ্গিত এসেছে ক্রেমলিন থেকে। তার প্রমাণও মিলেছে। আজ সোমবার রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
কার্চ সেতুর নিরাপত্তায় কিছু ক্যামেরা বসানো আছে। সেসব ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরণ যখন হয়, তখন ওই লরি সেতু দিয়ে যাচ্ছিল। ক্রেমলিনের দাবি, লরিটি রাশিয়ার ক্রাশনোদার শহর থেকে এসেছে। সেতুটি থেকে ক্রাশনোদারের দূরত্ব মাত্র আধা ঘণ্টার।
রাশিয়ার কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লরিটির মালিক সামির ইয়োসুবভ নামে ২৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি ক্রাশনোদারের বাসিন্দা। বিস্ফোরণের সময় লরিটির চালক ছিলেন মাখির ইয়োসুবভ। তিনি সামির ইয়োসুবভের আত্মীয়। কিন্তু ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বিস্ফোরণের সঙ্গে ওই লরির সম্পর্ক ছিল না।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সেতুর একটি উঁচু অংশ হয়ে লরিটি যাচ্ছিল। লরিটি যখন উঁচুতে উঠছিল, তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এ সময় বিস্ফোরণস্থল থেকে কিছুটা পেছনে ছিল লরিটি। বিস্ফোরণে সেতুর দুটি স্প্যান ধসে পড়ে। এর পরপরই সেতুর আরেকটি অংশে জ্বালানি ট্রাক বহনকারী ট্রেনে আগুন লাগে।
বিবিসি বলছে, বিস্ফোরণের পরপরই রাশিয়ায় এ তথ্য ছড়িয়ে পড়ে যে ট্রাক দিয়ে বোমা হামলা হয়েছে। কিন্তু এই তত্ত্ব কিছুটা সন্দেহ তৈরি করেছে। বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি তুলে ধরতে রাশিয়া বেশি আগ্রহী। ক্রেমলিনের ধারণা, অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে ইউক্রেন নাশকতামূলক এ হামলা করেছে।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ অবশ্য লরিবোঝাই বিস্ফোরক দিয়ে বোমা হামলার বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমি আমার পেশাজীবনে বড় বড় গাড়িতে বহু ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ দেখেছি। কিন্তু এ বিস্ফোরণ ছিল ব্যতিক্রম।’
আরও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে ওই বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলেন, লরি দিয়ে নয়, সম্ভবত সামুদ্রিক কোনো গুপ্তচর ড্রোন দিয়ে সেতুতে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘সেতু সাধারণত কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নকশা করা হয়। একটি হলো সেতুটির ওপর দিয়ে কতটা ভার নিতে পারে তা এবং পাশের দিক থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের গতি থামানো। নিচ থেকে কোনো চাপ এলে তা প্রতিরোধের বিষয়টি থাকে না। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টি ইউক্রেনের মাথায় ছিল।’ এই বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের দাবি, সেতুর ওপর লরি থেকে নয় বরং সেতুর নিচ থেকেই এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই কারণে দ্রুত সেতুর একটি অংশ ধসে পড়ে।
বিস্ফোরণের ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছেন এমন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেছেন, অন্য একটি নিরাপত্তা ক্যামেরায় দেখা গেছে, বিস্ফোরণটি ঘটার কিছুক্ষণ আগে সেতুর যেখানে বিস্ফোরণ হয়, তার নিচে ছোট নৌকার মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল। বিস্ফোরণের এক সেকেন্ডের কম সময় আগে সেখানে নৌকাটি ছিল।
ওই নৌকার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে হলে গত ২১ সেপ্টেম্বর রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবির প্রসঙ্গও আসে। কারণ, ওই ছবিতে দেখা যায়, ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল শহরের উপকূলে যে রুশ নৌঘাঁটি আছে, সেখানে রহস্যজনক একটি নৌকা ভেসে এসেছে। শনাক্ত করার মতো কিছু ছিল না সেটিতে।
ফাইবার বা কাঠ দিয়ে তৈরি নৌকাকে বলা হয় কায়াক। সেভাস্তোপল বন্দরে ভেসে আসা ওই নৌযান ছিল একটি কায়াক। এটিতে সেন্সরও ছিল। কায়াকে আরও ছিল গোপনে নজরদারির জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র পেরিস্কোপ। রুশ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্র দিয়ে ভাসিয়ে এনে এই কায়াক দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সেভাস্তোপলের গভর্নর বলেন, সেখান থেকে নাম না জানা একটি যানের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর বিস্ফোরণের মাধ্যমে যন্ত্রটি সমুদ্রে ধ্বংস করে ফেলা হয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে এমন যন্ত্র থাকার বিষয়টি অবশ্য এবারই যে প্রথম জানা গেছে, বিষয়টি তা নয়।
যুক্তরাজ্যের ওই বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে যে সমুদ্রে অভিযান, নজরদারি ও হামলা পরিচালনা করতে সক্ষম এমন অস্ত্র রয়েছে, তা ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিবেদনে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ধরনের অভিযান চালানোর জন্য কয়েক মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে অভিযানের পরিকল্পনা করতে হয়।
ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড থেকে শত শত মাইল দূরে অবস্থিত কার্চ সেতুতে কিয়েভ যদি সত্যি সত্যিই এভাবে ভয়াবহ একটি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, তাহলে বলতেই হবে, এটা কিয়েভের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি অভিযান। কিন্তু কিয়েভে ইউক্রেনের কিছু কর্তাব্যক্তির কানাকানি ছাড়া বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
এর আগে কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন রুশ রণতরি মস্কোভা ডুবে যাওয়া, গত আগস্টে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার বিমানঘাঁটিতে রহস্যজনক হামলার মতো এবার কার্চ সেতুতে হামলা নিয়েও কিয়েভের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হচ্ছে না। কারণ, এসব হামলা নিয়ে মানুষ যে যার মতো অনুমান করুক, সেটাই হয়তো চাইছে কিয়েভ।