যুদ্ধে পরস্পরকে মোকাবিলায় কী কৌশল নিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেনের বাহিনী
রাশিয়ার বিরুদ্ধে টানা দুই বছর ধরে সম্মুখযুদ্ধে লড়ছে ইউক্রেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাশিয়ার বাহিনীকে পিছু হটানোর পাশাপাশি নিজেদের হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে কিয়েভের এ লড়াই। জোগান, কৌশল আর সমতল ভৌগোলিক সীমানার দিকে তাকালে বোঝা যায়, ইউক্রেনের বহুল আলোচিত পাল্টা আক্রমণের কৌশল গত বছর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তব কিছু ফলাফল এনে দিয়েছে।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি রয়েছে। তাই ওই অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে সুরক্ষা পাওয়া তুলনামূলক কঠিন। সেখানে রুশবাহিনী নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য কয়েক মাস সময় পেয়েছে। তাই বেশ গভীরভাবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে পেরেছে তারা।
সারি সারি পরিখা (ট্রেঞ্চ), ট্যাংক-বিধ্বংসী প্রতিবন্ধকতা, খাদ এবং নতুন খোঁড়া কয়েক কিলোমিটার গভীর বাংকারগুলো ইউক্রেনীয় বাহিনীর সামনে একধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্মুক্ত প্রান্তরগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। কিন্তু সফলতা এসেছে সামান্যই।
ড্রোনের ওপর ইউক্রেনের বাহিনীর নির্ভরতার ধারণা দিতে গিয়ে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরোভ জানান, শুধু ২০২৩ সালেই অভ্যন্তরীণ ড্রোন উৎপাদন ৩ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা হিসেবেও ড্রোন পেয়েছে কিয়েভ।
এসব কারণে ইউক্রেনের বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ শ্লথ হয়ে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রাশিয়া এমন যুদ্ধকৌশল বেছে নিয়েছে যে প্রতি মিটার ভূখণ্ডের জন্য ইউক্রেনকে মূল্য চোকাতে হবে। রুশ বাহিনীর এমন কৌশলে কার্যত সফল হওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।
রুশ সেনাদের যোগ্যতা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে তাঁরা এখনো ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করে দিতে সক্ষম। সুরক্ষিত আশ্রয়স্থলে নিরাপদে অবস্থান, একাধিক নজরদারি ড্রোনের ব্যবহারের কারণে রুশ বাহিনী এমন একটা জায়গায় আছে, যা তাদের ওপর ইউক্রেনের বাহিনীর আকস্মিক হামলা ঠেকিয়ে দিতে পারে।
সেই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন-পুরোনো অস্ত্রের ব্যবহার পুরো ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথটাই বদলে দিয়েছে। যুদ্ধে নতুন কিছু কৌশলের ব্যবহার আমরা দেখেছি। ট্যাংকের ব্যবহার চালু রাখার মতো বেশ কিছু পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রব্যবস্থাকে সফল করেছে।
একুশ শতকের নতুন সব উদ্ভাবন থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ ইউক্রেনের যুদ্ধপরিস্থিতি ক্রমশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে। তাই তো এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে এক শতাব্দী আগের কোনো জেনারেলের কোনো সমস্যাই হবে না।
ড্রোন, ড্রোন এবং আরও ড্রোন
যুদ্ধরত উভয় পক্ষের কাছেই মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ বা ড্রোন একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। যদিও রাশিয়া এর ব্যবহার শুরু করতে অনেকটা সময় নিয়েছিল। এ জন্য তাদের যথেষ্ট মূল্য চোকাতে হয়েছে।
ইউক্রেনীয় বাহিনী ড্রোন ব্যবহার করে রুশ সেনাদের অবস্থানের ওপর ছোট ছোট গ্রেনেড ছুড়েছে। ফলে রুশ সেনাদের পরিখা ও ছোট গর্তে আটকা পড়তে হয়েছে। এ পরিস্থিতি তাদের শিবিরে হতাশা বাড়িয়েছে।
শনাক্ত করতে এসব ড্রোনে এমন কিছু ব্যাটারি ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যবহার করেছে, যা তাৎক্ষণিক ও দ্রুত আগুন ধরিয়ে দিতে পেরেছে। বিশেষ করে সমতল ও বৈশিষ্ট্যহীন উন্মুক্ত মাঠগুলোয় রাশিয়ার সেনা ও ট্যাংক পাকড়াও করতে এসব ড্রোন ভূমিকা রেখেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুশ বাহিনীও একই কৌশল লুফে নিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিয়েছে। অগ্রসর হওয়া ইউক্রেনীয় ইউনিটগুলো শনাক্ত করে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে তারা।
তাই বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে বিবদমান দুই পক্ষ শুধু নজরদারি ড্রোন নয়, বরং দূরপাল্লার যেসব ড্রোন শত্রুপক্ষের মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে, সেগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনী ইরান থেকে আমদানি করা শত শত শাহেদ-১৩৬ নামের ড্রোন সস্তা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
ধীরগতিতে উড়ে যাওয়ার সময় এসব ড্রোন ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমাগত ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। একযোগে ড্রোন, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কমিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে ইউক্রেনের নিজেকে রক্ষার সক্ষমতাও।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইউক্রেনের বাহিনী এটা শিখেছে, একটি শিল্প-পর্যায়ের যুদ্ধে সস্তা, কার্যক্ষম ও সশস্ত্র ড্রোনবহর খুবই দরকারি। সেই সঙ্গে তুলনামূলক দুর্বল একটি বিমানবাহিনীতে ভারসাম্য ফেরাতেও এটা সমানভাবে কার্যকর।
যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটি পর্যায়ে সংবেদনশীল অস্ত্র হিসেবে ড্রোনের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি পলিটিকোয় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের এক সেনা বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে একটি আর্টিলারি ইউনিটে যখন ড্রোন যুক্ত করা হয়, তখন ওই ইউনিটের নির্ভুলতা ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
তাই তো গণহারে ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইউক্রেন। এসব ড্রোন হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করতে পারবে। সে হিসাবে, ইউক্রেনের ড্রোনগুলো রাশিয়ার মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে হামলা চালাতে সক্ষম হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রেলওয়ে ডিপো, সমুদ্রবন্দর, সেনা ব্যারাকগুলো এখন আরও বেশি বেশি লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। আর এমনটা হলে সম্মুখসমরে রাশিয়ার সেনা ও রসদ পরিবহনে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ড্রোনের ওপর ইউক্রেনের বাহিনীর নির্ভরতার ধারণা দিতে গিয়ে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরোভ জানান, শুধু ২০২৩ সালেই অভ্যন্তরীণ ড্রোন উৎপাদন ৩ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা হিসেবেও ড্রোন পেয়েছে কিয়েভ।
চলতি বছর ১০ লাখের বেশি ড্রোন বানানোর লক্ষ্য ইউক্রেনের। এর অন্তত অর্ধেকেরই যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে দেশটি। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে আসতে পারে, এমন ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে ড্রোন উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে কিয়েভ।
শিল্প মূল বিষয়
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনিই জিতুন না কেন, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন কমার ঝুঁকি রয়েছে। এটা অভ্যন্তরীণ উদ্বেগের বড় একটি কারণ। সেই সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের মতো অন্য যুদ্ধের ক্ষেত্রেও মার্কিন সহায়তা ও সম্পদপ্রাপ্তি শিথিল হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
ইউক্রেনের যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা প্রয়োজন, দেশটি এখন আর সেটা পাচ্ছে না। এর বিপরীতে যুদ্ধকালে রাশিয়া সম্মুখসমরের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে মোট জাতীয় বাজেটের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে।
চলতি মাসে প্রকাশিত থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া এখন প্রতি মাসে ১২৫টি ট্যাংক বানাতে সক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া যে পরিমাণ ট্যাংক হারিয়েছে, তার চেয়ে বেশি এক মাসেই উৎপাদন করতে পারবে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তায় সম্ভাব্য ঘাটতি মোকাবিলায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরা ক্রমাগতভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, বিশেষত ড্রোন ও গোলাবারুদ উৎপাদন বাড়ানোকে এখন জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইউক্রেনের এখন প্রতি মাসে অতিরিক্ত ২ লাখ ৪০ হাজার শেল প্রয়োজন। কেননা, এখন দূরপাল্লায় বেশির ভাগ যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। তাই উভয় পক্ষেই গোলাবারুদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়ার সামরিক শিল্প বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও বিভিন্ন রকেট লঞ্চার ব্যবস্থার (এমএলআরএস) উৎপাদন বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়া থেকে বড় চালানে গোলাবারুদ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করছে রাশিয়া।
বর্তমানে ইউক্রেনের একটি গোলার বিপরীতে রুশ বাহিনীর অন্তত পাঁচটি গোলা ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে। কিছু অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনারা পরাজয় এড়াতে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে, দিনে কয়েকটি গোলা ছুড়ছে।
কঠিন কিছু শেখা
বিশ্বজুড়ে সামরিক বাহিনীগুলো একের পর এক সংঘাত দেখছে। এসব সংঘাত থেকে কঠিন কিছু শিখতে হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে গোলাবারুদ উৎপাদনের বিষয়টি খুব ছোট পরিসরে ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে দেখিয়ে দিয়েছে, সমপর্যায়ের কিংবা নিজেদের থেকে বড় কোনো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সামরিক শিল্পে কতটা শক্তিশালী হওয়ার দরকার।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতও খুবই কম ছিল। স্থল আক্রমণের জন্য ব্যবহারযোগ্য বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার রয়ে যাওয়া। বেশির ভাগই পারমাণবিক সক্ষমতার। এর সংখ্যা কয়েক শ হবে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে, এখন হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র দরকার। এর অর্থ হলো, স্বল্পমূল্যের আর দ্রুত বানানো যায়—এমন ক্ষেপণাস্ত্র এখন যেকোনো অস্ত্রাগারের মূল অংশ হয়ে উঠবে।
কাজেই এখন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হবে কয়েক স্তরের। আর এতে বিপুল পরিমাণে সস্তা ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেই সঙ্গে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন দ্রুত বাড়াতে হবে। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তা–ই।
২৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম স্ট্রম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এগুলো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। বানাতেও অনেক সময় লাগে। তাই এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যয়সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে সম্মুখসমরে ট্যাংকের ধারণা ফিরে এসেছে। যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে অনেক দেশের সামরিক বাহিনীতে ট্যাংকের সংখ্যা অব্যাহতভাবে কমে আসছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে, সঠিকভাবে সুরক্ষিত ও সম্মিলিত আক্রমণাত্মক যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে সম্মুখসমরে ট্যাংকের দুর্দান্ত ভূমিকা রয়েছে। এখনো এটি একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে রয়ে গেছে।
ড্রোনের কথায় ফিরে আসি। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটি পর্যায়ে সংবেদনশীল অস্ত্র হিসেবে ড্রোনের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি পলিটিকোয় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের একজন সেনা বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে একটি আর্টিলারি ইউনিটে যখন ড্রোন যুক্ত করা হয়, তখন ওই ইউনিটের নির্ভুলতা ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
অনুবাদ করেছেন: অনিন্দ্য সাইমুম