যুদ্ধের ময়দানে কী ঘটেছে, উঠে এল রুশ সেনার বয়ানে
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোররাত আনুমানিক চারটা। রুশ ছত্রীসেনা পাভেল ফিলাতেভ (৩৩) সহকর্মী সেনাদের সঙ্গে গোলাবারুদভর্তি একটি ট্রাকে ছিলেন। এমন সময় রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালাচ্ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া।
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আশায় পাভেল এখন ফ্রান্সে। তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম মনে হয়েছিল, উন্মাদের মতো কিছু একটা ঘটছে। রকেট ও কামানের গোলা ছোড়া হচ্ছিল। আপনি যখন সীমান্ত (ক্রিমিয়া-ইউক্রেন) অতিক্রম করতে করতে দেখছেন যে ১০টি যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, অন্যদিকে উড়ছে ১০টি হেলিকপ্টার এবং ট্যাংকগুলো আপনার পাশে ঘোরাঘুরি করছে, তখন আপনার মনে হবে, আপনি একটি গুরুতর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন।’
এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই পাভেল যে ইউনিটে ছিলেন, সেই ইউনিট ইউক্রেন সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। তাঁদের কাছে থাকা মুঠোফোন জমা দিতে বলা হয়। কারণ, তাঁরা যাতে ইন্টারনেট ব্যবহার বা কোনো বন্ধুকে ফোন করে জানাতে না পারেন, প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে। ফলে ইউক্রেনে কী হচ্ছে, পাভেল সেটা জানতেনই না। তিনি শুধু জানতেন, রুশ বাহিনীর একটি বড় বহরের সঙ্গে তিনি রয়েছেন। সেনাদের এই বহর ক্রিমিয়া সীমান্ত হয়ে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
পাভেল বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি, এটা সত্যিকারের এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। তবে কয়েক দিন পার হওয়ার পর আমি আর বুঝতে পারছিলাম না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ন্যাটো (যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট) সেনারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। জবাব দিতেই পাল্টা হামলা করছি।’
যুদ্ধের ছয় মাস পার হয়েছে। যুদ্ধে থাকা রুশ সেনাদের গতি কমেছে। সংখ্যায়ও কমে গেছেন তাঁরা। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তার একটা বিবরণ উঠে এসেছে পাভেলের কথায়। দুই মাসের যুদ্ধের কথা ১০৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন তিনি। এর নাম দিয়েছেন ‘জোভ’। রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন তিনি।
পাভেল যুদ্ধের বর্ণনায় বলেন, ‘আমি শুধু আমার হাতে থাকা অস্ত্র ফেলে পালাতে পারছিলাম না, কারণ, একজন সৈনিকের জন্য এটা কাপুরুষতা। সবাই তো এটা বোঝে না, তবে আমরা আমাদের এই দেশপ্রেমের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি যদি জীবিত অবস্থায় এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারি, তাহলে এখান থেকে বের হওয়ার পর যুদ্ধ বন্ধে আমার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করব। আমি সিদ্ধান্ত নিই, সবচেয়ে ভালো হবে যা দেখলাম, তা লিখে রাখা।’
পাভেল বলেন, ‘আমি তখন যা দেখেছি, যা অনুভব করেছি বা যখন ভয়ে মুছড়ে পড়েছি, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা কোনো অতিরঞ্জন ছাড়াই লেখার চেষ্টা করেছি।’ পাভেল জানান, তিনি শুধু রাশিয়ার পাঠকদের এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁরা টেলিভিশনে যা দেখেছেন, তার তুলনায় তিনি যা বলছেন, সেটা নিরেট সত্য ঘটনা।
পাভেলের বাবা ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। তাঁর বাবা চেচনিয়ায় দায়িত্ব পালন করেছেন। পাভেল বলেন, ক্রিমিয়া সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের পর তা দখলে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাঁদের। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের ইউনিট ইউক্রেনের তেমন প্রতিরোধ ছাড়া খেরসন দখলে নেয়।
এরপর পাভেল ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য সেনাদের মিকোলাইভের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে পাভেলের ইউনিট অবস্থান নেয়। কারণ, সেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণ করেছে। পাভেলের সহযোদ্ধা বেশ কয়েকজন সেনা এতে নিহত হয়েছেন। এরপরের কয়েক মাস রুশ বাহিনী মিকোলাইভ দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনীয় সেনাদের তুমুল প্রতিরোধের মুখে রুশ বাহিনী মিকোলাইভের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে পাভেল বলেন, ‘আমরা এক সপ্তাহ এমনভাবে ছিলাম যখন আমাদের ঘুমানোর পর্যন্ত সুযোগ হচ্ছিল না। বারবার আমরা ইউক্রেনীয় বাহিনীর গুলির সীমায় পড়তে থাকি এবং আমরা বুঝতে পারছিলাম না কেন আমাদের এভাবে ঘোরানো হচ্ছে। তুমুল গোলাবর্ষণ চলছে। এর মধ্যেই আমাদের বাস করতে হচ্ছে, ঘুমাতে হচ্ছে। কিন্তু একসময় আপনি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। ১০০ মিটার দূরে একটি বিস্ফোরণ হয়েছে, কিন্ত এর মধ্যেই ঘুমাতে হয় আমাদের।’
গোপন পরিখা খনন করে এভাবে অন্য সেনাদের সঙ্গে এক মাস ছিলেন পাভেল। তবে সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে আর যুদ্ধ করতে হয়নি। একটি বিস্ফোরণে পাভেলের চোখে সমস্যা হয়। এরপর তাঁকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়ার একটি হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে পাভেল টিভি দেখার সুযোগ পান। টিভি দেখে তিনি তুলনা করার সুযোগ পান, যুদ্ধের ময়দানে এক মাস থেকে একজন সৈনিক হিসেবে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর মানুষকে যা দেখানো হচ্ছে, তার পার্থক্য কোথায়!
পাভেল বলেন, ‘হাসপাতালে টিভি ছিল কিন্তু আমার কাছে তখনো এমন মুঠোফোন ছিল না, যেটা দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। তাই আমি টিভিই দেখতাম। আমি বুঝতে পারতাম না তারা (টিভিতে) কী বলছে। আমি যা দেখেছি তা শুধু যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। তারা আমাকে বলছে, এটা বিশেষ অভিযান। নাৎসি–সংক্রান্ত। হ্যাঁ, একদা ইউক্রেনীয়রা আমাদের শত্রু ছিল কিন্তু তারা ফ্যাসিস্ট নয়। আমি জানি, টিভিতে যে প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছে, সেগুলো যুদ্ধের ময়দান থেকে আসা খবর নয়। কারণ, আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে একজন সাংবাদিককেও দেখিনি। ফলে যুদ্ধ নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা আর টিভিতে যা দেখাচ্ছে, তার পুরোটাই বাকোয়াজ।’