ইউক্রেনের জন্য গত সপ্তাহটা বেশ ভালো খবর বয়ে এনেছিল। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডাসহ পশ্চিমা মিত্ররা দেশটিকে অত্যাধুনিক ট্যাংক সরবরাহের কথা জানিয়েছে। এর ফলে চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে কিয়েভের আত্মবিশ্বাস নিঃসন্দেহে বেড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব ট্যাংক ইউক্রেনকে কতটা এগিয়ে দেবে? যুদ্ধ জয়ে দেশটির সামনে কেমন সুযোগ তৈরি করবে? নাকি এর মধ্য দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে?
ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমাদের সহায়তা প্যাকেজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হল সাঁজোয়া যান, কামান ও নির্ভুল আঘাত হানতে পারে এমন অস্ত্র। প্রতিশ্রুত স্বল্পসংখ্যক ট্যাংক এই প্যাকেজের তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।– মিখায়েল কফম্যান, রাশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক, সিএনএ।
ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা শুধু ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক ট্যাংক ও সমরাস্ত্র দিচ্ছে না, একই সঙ্গে এসব পরিচালনার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেবে। এটি একটি ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ হতে যাচ্ছে, যাকে মার্কিন বাহিনী ‘সমন্বিত অস্ত্র যুদ্ধ’ বলছে। বছরজুড়ে না হলেও এই কর্মসূচি মাসখানেক চলতে পারে।
নতুন সামরিক সাহায্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হোয়াইট হাউস এবং ন্যাটো জোটের জন্য একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক কাজ। যদিও তারা কিয়েভকে এমন নতুন ক্ষমতা প্রদান করতে চায়, যা যুদ্ধক্ষেত্রের অচলাবস্থা ভাঙার সম্ভাবনা রাখে। তারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও উসকানি দিতে চায় না, যিনি যুদ্ধকে বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
কিয়েভকে নতুন করে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি হোয়াইট হাউস ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক কৌশলের অংশ। তারা একদিকে ইউক্রেনের সক্ষমতা এমনভাবে বাড়াতে চায়, যা যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্যমান অচলাবস্থা ভাঙতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে পশ্চিমারা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সরাসরি এমন কোনো উসকানি দিতে আগ্রহী নয়, যাতে তিনি যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার পথে নিয়ে না যান।
ফলাফল হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে যখন পশ্চিমারা কিয়েভকে অত্যাধুনিক ট্যাংক দিতে দ্বিধায় ভুগছিল, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, তখন রাশিয়া এই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। এখন পশ্চিমা অস্ত্র প্রশিক্ষণে নতুন ইউক্রেনীয় সেনা ইউনিট (পশ্চিমা সহায়তার ট্যাংক পরিচালনাকারী) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের লাগাম টানার এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে যখন পশ্চিমারা কিয়েভকে অত্যাধুনিক ট্যাংক দিতে দ্বিধায় ভুগছিল, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল, তখন রাশিয়া এই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। এখন পশ্চিমা অস্ত্র-প্রশিক্ষণে নতুন ইউক্রেনীয় সেনা ইউনিট (পশ্চিমা সহায়তার ট্যাংক পরিচালনাকারী) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের লাগাম টানার এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
ইতিমধ্যে স্যাটেলাইট থেকে তোলা বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে, যুদ্ধক্ষেত্রে রুশবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক পরিখা খননের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই মার্কিন প্রশাসন ধারণা করেছিল, রাশিয়া বড় ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে ইউক্রেনে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতে পারে বলে পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছিল। শীত মৌসুমের শুরুতে যুদ্ধ পরিস্থিতি অনেকটা রাশিয়ার পক্ষে ঝুঁকে যায়। এতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একের পর এক বৈঠক করে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় তারা যুদ্ধের মোড় ইউক্রেনের পক্ষে ঘুরিয়ে নেওয়ার কৌশল নির্ধারণে আলোচনা করছে।
এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড গত বৃহস্পতিবার দেশটির সিনেটকে জানান, আমরা তাদের (ইউক্রেনীয় সেনাদের) এমন একটি সম্ভাব্য সর্বোত্তম অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, যাতে চলমান যুদ্ধ মাঠেই শেষ হয়। কিংবা কূটনীতি বা দুটির সমন্বয়ে হতে পারে। তারা (ইউক্রেনীয়রা) এমন একটি মানচিত্রে বসে আছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য বেশ সুবিধাজনক। আর এতেই পুতিন তাঁর কৌশলগত ব্যর্থতা অনুভব করেন।
প্রথম বছরে ইউক্রেন ও রাশিয়া—দুই পক্ষই যুদ্ধ কামানের ব্যবহার বেশি করেছে। কোথাও কোথাও ট্যাংক বহর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে। আর পরবর্তী সময়ে আকাশপথে যুদ্ধ জোরালো হয়েছে। ইউক্রেনের অন্যতম সাফল্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খারকিভের আশপাশে ট্যাংক বহর ব্যবহার করে পাল্টা-আক্রমণ চালানো। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র দ্রুতগতির সাঁজোয়া যানে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে অসংগঠিত রুশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন ইউক্রেনের সেনারা।
কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে ইউক্রেনের সেনারা রুশবাহিনীর খনন করা পরিখাকে (বাংকার) লক্ষ্যবস্তু বানাবে। এর মধ্য দিয়ে ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনীর একযোগে হামলা চালানোর পথ সুগম হবে। অগ্রভাগে ট্যাংক ইউনিট হামলা চালাবে। এর পরে থাকবে কামান, তারপর পদাতিক সেনারা। এই ধরনের সম্মিলিত হামলার কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ অভিযানের মেরুদণ্ড। মার্কিন সেনাদের এমন যুদ্ধ কৌশলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তাই তারাও আগামী দিনগুলোয় ইউক্রেনের সেনাদের এই কৌশল শেখাতে পারেন।
যদিও পশ্চিমা সহায়তার ট্যাংকগুলো এখন মনোযোগের কেন্দ্রে আছে। এরপরও বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঠে বাঁকবদল ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১০৯ ব্র্যাডলি সাঁজোয়া যান ও ইউরোপীয় মিত্রদের দিতে চাওয়া বিপুলসংখ্যক আর্টিলারি বন্দুক।
জার্মানির দেওয়া লেপার্ড ট্যাংক ইউক্রেনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নতুন ইউনিটের যেসব সেনারা ব্যবহার করবেন, তাঁদের সঙ্গে এসব অস্ত্রের সমন্বয় ঘটাতে হবে। মার্কিন সেনাবাহিনীর চর্চা করা সমন্বিত এই যুদ্ধ কৌশল তাঁদেরও শেখাতে হবে। যখন পশ্চিমা সহায়তার সব অস্ত্র-সরঞ্জাম হাতে চলে আসবে, তখন কিয়েভ অতিরিক্ত তিনটি ব্রিগেড তৈরি করতে পারবে।
এ বিষয়ে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএর রাশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষক মিখায়েল কফম্যান বলেন, ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমাদের সহায়তা প্যাকেজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো সাঁজোয়া যান, কামান ও নির্ভুল আঘাত হানতে পারে এমন অস্ত্র। প্রতিশ্রুত স্বল্পসংখ্যক ট্যাংক এই প্যাকেজের তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।