ইউরোপজুড়ে মুসলিমরা এখন বর্ণবাদের ‘উদ্বেগজনক বৃদ্ধির’ সঙ্গে লড়াই করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা এ মন্তব্য করে বলেছে, বর্ণবাদ এমন বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ‘অমানবিক মুসলিমবিদ্বেষী বাগাড়ম্বর’।
ইউরোপে বর্ণবাদের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওই সংস্থা। জরিপে দেখা গেছে, এতে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের প্রায় অর্ধেকই বলেছেন, সম্প্রতি তাঁরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
ইইউ এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস (এফআরএ) নামের সংস্থাটির এ প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়। ইউরোপের ১৩টি দেশের ৯ হাজার ৬০০ জন মুসলিম নারী–পুরুষ সংস্থাটির জরিপে অংশ নেন।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ইউরোপ মহাদেশজুড়ে বর্ণবাদ ও বৈষম্য মুসলিমদের জীবনযাত্রার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৈরি করছে নানা হুমকি।
মুসলিমরা বলছেন, এ বর্ণবাদ ও বৈষম্যের প্রকাশ ঘটছে নানাভাবে। যেমন তাঁদের সন্তানেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে, চাকরির ক্ষেত্রে অসমতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, এমনকি বাড়ি কেনা বা ভাড়া নিতে গেলেও পক্ষপাত করা হচ্ছে।
মুসলিমরা বলছেন, এই বর্ণবাদ ও বৈষম্যের প্রকাশ ঘটছে নানাভাবে। যেমন তাঁদের সন্তানেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে, চাকরির ক্ষেত্রে অসমতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, এমনকি বাড়ি কেনা বা ভাড়া নিতে গেলেও পক্ষপাত করা হচ্ছে।
এই জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগে। ওই দিন ইসরায়েলে নজিরবিহীন রকেট হামলা চালান ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধারা। এর প্রতিশোধ নেওয়ার অজুহাত তুলে সেদিন থেকেই গাজায় নারকীয় তাণ্ডব শুরু করেছে ইসরায়েল।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এফআরএ বলছে, যদিও এ জরিপ ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধ শুরুর আগে করা হয়েছে, তবু নাগরিক সংগঠনগুলো ও বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে এ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ওই সংঘাত শুরুর পর থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে।
এ বিষয়ে সংস্থার পরিচালক শিরপা রাউতিয়ো বলেন, ‘ইউরোপে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আমরা বর্ণবাদ ও বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখছি। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের কারণে উসকে উঠছে। মুসলিমবিরোধী অমানবিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তায় মহাদেশজুড়ে এ বর্ণবাদ ও বৈষম্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।’
৭ অক্টোবরের পর প্রধানত মুসলিম ও কিছু ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের ঘটনা বেড়ে যাওয়া মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা। এসবের মধ্যে আছে জার্মানির বার্লিনে একটি সিনাগগে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা থেকে শুরু করে ফ্রান্সে বিভিন্ন মুসলিম কাউন্সিল এবং মসজিদ কর্তৃপক্ষকে হুমকিসংবলিত ও অপমানজনক বেশ কিছু চিঠি পাঠানোর ঘটনা।
অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও সুইডেনের মুসলিমদের সঙ্গে কথা বলেছে মানবাধিকার সংস্থা এফআরএ। দেখা গেছে, ২০২২ সালের আগে পাঁচ বছরে বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁদের ৪৭ শতাংশ। ২০১৬ সালের তুলনায় এটি ৩৯ শতাংশ বেশি।
জরিপ প্রতিবেদনের সহরচয়িতা ভিডা বেরেসনেভিসিউটে বলেন, ‘আমরা দেখছি, মুসলিমদের অবস্থা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হচ্ছে। ইউরোপে একজন মুসলিম হিসেবে বসবাস করাটা আগের চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।’
বিশ্লেষকেরা বলেন, বৈষম্যের ঘটনা মূলত ইউরোপে কট্টর ডানপন্থী দলগুলোর উত্থানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যেমন অস্ট্রিয়ায় নাৎসিবাদীদের প্রতিষ্ঠিত অভিবাসীবিরোধী ফ্রিডম পার্টির (এফপি) সম্প্রতি উত্থান ঘটেছে। তারা সেখানে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। ৭১ শতাংশ মুসলিম বৈষম্যের শিকার হওয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন দেশটিতে। প্রতিবেশী জার্মানিতে আরেক অভিবাসীবিরোধী দল অলটারনেটিভ ফার ডয়েচল্যান্ড ক্রমেই বেশি সমর্থন পাচ্ছে। সেখানে ৬৮ শতাংশ মুসলিম জানিয়েছেন, তাঁরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
ইউরোপে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আমরা বর্ণবাদ ও বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখছি। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের কারণে উসকে উঠছে। মুসলিমবিরোধী অমানবিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তায় মহাদেশজুড়ে এ বর্ণবাদ ও বৈষম্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।শিরপা রাউতিয়ো, ইইউ এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটসের (এফআরএ) পরিচালক
জরিপে অংশ নেওয়া ১৩টি দেশের ৩৯ শতাংশ মুসলিম চাকরিতে বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর কর্মরত মুসলিমদের ৪১ শতাংশ জানিয়েছেন, চাকরি পেতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে তাঁদের।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৫ শতাংশ বলেছেন, বৈষম্যের কারণে তাঁরা বাড়ি কিনতে বা ভাড়া করতে বাধা পেয়েছেন। এ হার ২০১৬ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। বেরেসনেভিসিউটে বলেন, ‘বৈষম্যের এমন ঘটনা ব্যাপক, স্থায়ী আর অপ্রতিরোধ্য।’
চলমান এ বর্ণবাদের প্রভাবও সুদূরপ্রসারি ও দীর্ঘমেয়াদি। যার ফলাফল হিসেবে মুসলিমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাচ্ছেন ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন। এ ছাড়া আগের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি মুসলিম বসবাস করছেন অস্থায়ী চুক্তিতে। আবার সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় আগেভাগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়ছেন তিন গুণ মুসলিম।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে প্রধানত মুসলিম ও কিছু ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের ঘটনা বেড়ে যাওয়া মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা। এসবের মধ্যে আছে জার্মানির বার্লিনে একটি সিনাগগে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা থেকে শুরু করে ফ্রান্সে বিভিন্ন মুসলিম কাউন্সিল এবং মসজিদ কর্তৃপক্ষকে হুমকিসংবলিত ও অপমানজনক বেশ কিছু চিঠি পাঠানোর ঘটনা।
‘বিশেষত, তরুণ মুসলিমদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনা বেশি উদ্বেগজনক’, বলেন বেরেসনেভিসিউটে। ইউরোপে জন্মগ্রহণকারী মুসলিমদের অর্ধেকের বেশি (৫৫ শতাংশ) বলেন, গত পাঁচ বছরে চাকরি পেতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। এই তরুণেরা ইঙ্গিত দেন, ভাষাগত সক্ষমতা ও অন্য যোগ্যতা একই থাকার পরও তাঁদের অন্যদের সঙ্গে সমান চোখে দেখা হয়নি।
বেরেসনেভিসিউটে বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। অনেক মুসলিমই একাধিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এ বৈষম্যে পেছনে রয়েছে, তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়। পাশাপাশি আছে গায়ের রং এবং জাতিগত বা অভিবাসন–সংক্রান্ত অতীত যোগসূত্র।’
যেসব মুসলিম নারী ধর্মীয় পোশাক যেমন, স্কার্ফ পরেন, তাঁরাও চাকরি ক্ষেত্রে বেশি বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে, পোশাকের কারণে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণীদের মধ্যে এমন বৈষম্যের শিকার হওয়ার হার বেশি (৫৮ শতাংশ)।
আমরা দেখছি, মুসলিমদের অবস্থা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হচ্ছে। ইউরোপে একজন মুসলিম হিসেবে বসবাস করাটা আগের চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।ভিডা বেরেসনেভিসিউটে, জরিপ প্রতিবেদনের সহরচয়িতা
এ অবস্থায় ইইউ সদস্যদেশগুলোকে বৈষম্য ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা এফআরএ। সেই সঙ্গে আইনপ্রণেতারা যাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন, সে লক্ষ্যে এ বিষয়ে মানসম্মত তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছে তারা। দুঃখের বিষয়, যুক্তরাজ্য ছাড়া অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশই বর্ণ বা জাতিগত বৈচিত্র্য নিয়ে আদমশুমারির তথ্য সংগ্রহ করে না।
এ জরিপ প্রতিবেদনের আগে গত বছর ইউরোপে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
সব মিলিয়ে প্রতিবেদনে এ ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে বর্ণবাদ ও বর্ণবাদী বৈষম্য ইউরোপজুড়ে এক স্থায়ী ঘটনায় রূপ নিয়েছে। এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া এর বিলোপ অসম্ভব।