অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও একজোট বিরোধীরা, শেষ রক্ষা হবে কি এরদোয়ানের
আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেকোনো মূল্যে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে চান রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। নিজের শুরুর সাফল্যের সময়কার ‘শূন্য শত্রু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে শূন্য সমস্যানীতিতে’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন তিনি।
আগামী বছরের জুনে তুরস্কের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে দেশটির এবারের নির্বাচন গত দুই দশকের মতো হচ্ছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বিরোধীদের বিশ্বাস, ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ও রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শাসনের ইতি ঘটাতে পারবেন তাঁরা। দেশটির চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে কাজে লাগিয়ে একেপি ও এরদোয়ানকে ঘায়েল করতে চান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীরা। অথচ এই অর্থনৈতিক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়েই তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী থেকে অঘোষিত সুলতান হয়ে বসেন এরদোয়ান।
তুরস্কের এই মারাত্মক অর্থনৈতিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জের মানে হলো ২০০২ সালের পর এরদোয়ান ও তাঁর দল সবচেয়ে কঠিন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে যাচ্ছেন। যদিও পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল কী হবে, তা এখন পর্যন্ত অনেকটাই অনিশ্চিত।
সেপ্টেম্বরে একাধিক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গত নির্বাচনের তুলনায় একেপির সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একেপি ৩০-৩৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পাচ্ছে। দলটির মিত্র ন্যাশনাল মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি) পাচ্ছে ৭ শতাংশ ভোট। একেপির ভোটে ভাগ বসিয়েছে মূলত গুড পার্টি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১৫ শতাংশই দলটিকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি গত নির্বাচনের মতো ২৩-২৪ শতাংশ ভোট পাবে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সাফল্য
অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকায় একসময় ব্যঙ্গ করে তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ণ মানুষ’ বলা হতো। সেই তুরস্ককে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেন এরদোয়ান। তিনি ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বীকৃতি হিসেবে মধ্যবিত্তের সমর্থন নিয়ে তিনি আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসকে পরিণত হন।
১৯৭০ সাল থেকেই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও মন্দা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল এরদোয়ানের দল। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে জনগণ এরদোয়ানের একেপিকে ক্ষমতায় বসায়। এক দশকের এই সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এরদোয়ান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে পশ্চিমাদের দিকে সুসম্পর্ক রেখে চলেন।
ভক্ত ও অনুগত সমর্থকদের শক্ত ভিত্তি রয়েছে এরদোয়ানের। তাঁরা বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় চলা কামালপন্থীদের (কামাল আতাতুর্ক) শাসনের চেয়ে তাঁর আমলে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত জীবন যাপন করেছেনসোনের চাগাপ্তাই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, তুর্কি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক
একেপি সরকার তুরস্ক থেকে দারিদ্র্য বিদায় করে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এক দশক আগে তিন অঙ্কে থাকা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুর্কি মুদ্রা লিরার চাহিদা বাড়ান। অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সামরিক খাতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেন। এমন সাফল্যে রীতিমতো আকাশে উড়ছিলেন এরদোয়ান।
তুর্কি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সোনের চাগাপ্তাই ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের জন্য লেখা এক রিপোর্টে বলেছেন, ‘ভক্ত ও অনুগত সমর্থকদের শক্ত ভিত্তি রয়েছে এরদোয়ানের। তাঁরা বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় চলা কামালপন্থীদের (কামাল আতাতুর্ক) শাসনের চেয়ে তাঁর আমলে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত জীবন যাপন করেছেন।’
ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর আর বসনিয়া থেকে জিনজিয়াং—মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের বিষয়েও উচ্চকণ্ঠ হন এরদোয়ান। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসলামভীতিসহ নানা বিষয় তিনি সোচ্চার হন। দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আফ্রিকায় বিশেষ অবস্থান তৈরিতে নজর দেয় তুরস্ক। এসবের নেপথ্যে ছিল মূলত এরদোয়ানের সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার সুপ্ত বাসনা।
আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন
অর্থনৈতিক সাফল্যের পথ ধরে ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এরদোয়ান। তুরস্কের অতীত শৌর্যবীর্যে স্মৃতিকাতর এরদোয়ান। তিনি একসময় উসমানি খেলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর প্রতি নজর দেন। গত দশকের অধিকাংশ সময়ই তুরস্ক ব্যয় করে নিজের প্রভাব বাড়াতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ভাবমূর্তি পুনর্নির্মাণে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) অ্যাসোসিয়েট সিনিয়র পলিসি ফেলো আসলি আইদিনতাসবাস। ‘রাজনীতির ঘেরাটোপ: মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্যের খোঁজে তুরস্ক’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তুরস্কের এই প্রচেষ্টা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে লিবিয়া থেকে সিরিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বড় লড়াইয়ের সীমারেখা তৈরি করে।
ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর আর বসনিয়া থেকে জিনজিয়াং—মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের বিষয়েও উচ্চকণ্ঠ হন এরদোয়ান। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসলামভীতিসহ নানা বিষয় তিনি সোচ্চার হন। দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আফ্রিকায় বিশেষ অবস্থান তৈরিতে নজর দেয় তুরস্ক। এসবের নেপথ্যে ছিল মূলত এরদোয়ানের সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার সুপ্ত বাসনা।
আরব বসন্তে সমর্থনের মাশুল
আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিজের গায়ে আগুন দিয়ে বিপ্লবের মশাল জ্বেলে দেন তিউনিসিয়ার নাগরিক মোহাম্মদ বুয়াজিজি। ঘুষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ওই বিদ্রোহের আগুন আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশ হচ্ছে—মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়া। আরব বসন্ত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক স্বৈরশাসক উৎখাত হয়েছেন।
এই বিক্ষোভের নেপথ্যের সংগঠক ছিল মূলত ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড। সংগঠনটি আরব রাজপরিবার ও স্বৈরশাসকদের চক্ষুশূল। প্রতিবিপ্লব আর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে আরব বিপ্লব হারিয়ে যেতে বেশি সময় নেয়নি। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে কিছু সময় পরই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন রাজপরিবারগুলো ও তাঁদের মিত্র স্বৈরশাসকেরা। কোথাও আবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে এক দশকের বেশি সময় ধরে।
আমরা এক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনযাপন করছি। সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মুদ্রার মান হুড়মুড় করে পড়ে গেছে। আমাদের লিরা সব মূল্যমান হারিয়েছেআয়সে কায়া, ইস্তাম্বুলের বাসিন্দা
রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়াড় এরদোয়ান কূটনীতিতে সবচেয়ে ভুল বাজি ধরেছিলেন আরব বসন্তে সমর্থন দিয়ে। সুন্নি বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে আগে থেকেই চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ। আরব বসন্তে সমর্থন দিলে তা ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। তুরস্কের বিরুদ্ধে এক হয়ে নামেন আরব স্বৈরশাসকেরা। এই লড়াইয়ে এরদোয়ানের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়তে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যেরে উদীয়মান নেতা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। যেখানে এরদোয়ান, সেখানে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান তিনি। তুরস্কের পণ্য আমদানির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করে সৌদি-আমিরাত নেতৃত্বাধীন জোট।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
জনপ্রিয়তায় উড়তে থাকা এরদোয়ান প্রথম বড় ধাক্কাটা খান ২০১৩ সালে। গেজি পার্ক গুঁড়িয়ে দিয়ে শপিংমল বানানোর উদ্যোগের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে গেজি পার্ক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো গণ-অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এরদোয়ান প্রশাসন কঠোর হাতে এই বিক্ষোভ দমন করলে সরব হয় পশ্চিমা বিশ্ব। বিক্ষোভে পশ্চিমারা উসকানি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন এরদোয়ান। এরপর থেকে তাঁর প্রশাসনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দূরত্ব বাড়তে থাকে। পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ তুরস্ক।
এরপর নিজের ক্ষমতা আরও পোক্ত করার পথে হাঁটেন এরদোয়ান। তিনি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করেন। এরদোয়ান ২০১৪ সালের আগস্টে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিরোধীরা তাঁর এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। ভিন্নমত আসে নিজ দলের মধ্য থেকেও। এরদোয়ানকে ছেড়ে যান তাঁর একসময়কার বিশ্বস্ত সঙ্গীরাও।
সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইএনএজির হিসাবে তা প্রায় দ্বিগুণ (১৫০ শতাংশ)। মে মাসে দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৪৮০ কোটি) ডলারে নেমে যায়। চলতি বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার বিনিময় হার ছিল সবচেয়ে দুর্বল। শুধু গত বছরে ডলারের বিপরীতে ৪০ শতাংশ মূল্যমান হারায় লিরা।
ভোটের রাজনীতি দিয়ে এরদোয়ানকে হটানো অসম্ভব ঠেকে। এরপর ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে হটানোর চেষ্টা হয়। তবে অতীতের সেনাশাসনে অতিষ্ঠ জনতার নজিরবিহীন সাহসিকতায় রক্তক্ষয়ী এই অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে যান এরদোয়ান। অভ্যুত্থানের সময় অবকাশযাপনে ছিলেন তিনি। তাঁর রিসোর্টে বিদ্রোহী সেনাদের অভিযানের কিছুক্ষণ আগে তিনি সেখান থেকে সরে যেতে সক্ষম হন।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জন্য নিজের একসময়কার মিত্র ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেন এরদোয়ান। তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ, গুলেন তুরস্কের আয়াতুল্লাহ খোমেনি হতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে বছরের পর বছর সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে নিজের লোক বসিয়ে সরকারের ভেতর আরেক সরকারব্যবস্থা জারি করেন তিনি। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তাঁর অনুসারীদের ওপর চড়াও হন এরদোয়ান। সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের হাজার হাজার সদস্যকে চাকরিচ্যুত ও কারাগারে পোরেন তিনি।
মূলত এর পর থেকেই তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। বিরোধীদের দমন-পীড়নের অভিযোগে পশ্চিমাদের অঘোষিত অবরোধ শুরু হয়। বিনিয়োগে আগ্রহ হারায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। তুরস্কের গাড়ি কারখানায় ১৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ স্থগিত করে ভক্সওয়াগনের মতো জায়ান্ট গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের অন্যতম রপ্তানি পণ্য স্টিলের ওপর শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ (২৫ থেকে ৫০ শতাংশ) করলে দেশটির অর্থনীতিতে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির তৈরি হয়।
সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইএনএজির হিসাবে তা প্রায় দ্বিগুণ (১৫০ শতাংশ)। মে মাসে দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৪৮০ কোটি) ডলারে নেমে যায়। চলতি বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার বিনিময় হার ছিল সবচেয়ে দুর্বল। শুধু গত বছরে ডলারের বিপরীতে ৪০ শতাংশ মূল্যমান হারায় লিরা।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে অনেকটা এভাবেই বললেন ইস্তাম্বুলের ৬০ বছর বয়সী বাসিন্দা আয়সে কায়া, ‘আমরা এক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনযাপন করছি। সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মুদ্রার মান হুড়মুড় করে পড়ে গেছে। আমাদের লিরা সব মূল্যমান হারিয়েছে।’
ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের হাতে এরদোয়ানেরই অস্ত্র
তুরেস্কের বিরোধী দলগুলোর অদক্ষতা ও বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকার সমালোচনা অনেক পুরোনো। তবে মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও এবার তারা নির্বাচনী জোট গড়েছে। সবার লক্ষ্য একটাই—এরদোয়ানকে হটানো। ছয়দলীয় জোটে রয়েছেন এরদোয়ানেরই একসময়কার সাফল্যের সঙ্গীরা। ২০১৯ সালে আঙ্কারা, ইস্তাম্বুলসহ কয়েকটি বড় শহরে মেয়র পদে জয় পায় ঐক্যবদ্ধবিরোধী জোট। এই ফলাফলই তাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে।
২০২১ সালে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টিসহ (সিএইচপি) ছয়দলীয় জোট গঠিত হয়। বাকি দলগুলো হলো মধ্য-ডান গুড পার্টি, ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড প্রোগ্রেস পার্টি (ডিইভিএ), ইসলামপন্থী ফেলিসিটি পার্টি, ডেমোক্র্যাট পার্টি ও ফিউচার পার্টি। এর মধ্যে ডিইভিএ গড়েছেন এরদোয়ানের একসময়কার অর্থনৈতিক কৌশলবিদ আলি বাবাকান। ফিউচার পার্টি গড়েছেন এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আহমেত দাভুতোলু। এরদোয়ানের আমলে দীর্ঘ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৪৮ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে ছয়দলীয় জোট। তাদের অন্যতম অঙ্গীকার তুরস্ককে আবার সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া। রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার আর ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তবে এরদোয়ানকে ঘায়েল করতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়কেই কাজে লাগাতে চান বিরোধীরা। অর্থনৈতিক সাফল্য দিয়েই ক্ষমতার রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন এরদোয়ান।
সম্মিলিতভাবে প্রার্থী দিতে পারলে এরদোয়ানকে হারানো সম্ভব বলে মনে করছে বিরোধী জোট। বিশেষ করে তাঁর জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারেন সাবেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাবাকান ও দাভুতোলু। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন ‘লৌহমানবী’খ্যাত গুড পার্টির চেয়ারপারসন মেরাল আকসেনেরও। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে লড়তে পারেন ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু ও আঙ্কারার মেয়র মনসুর ইয়াভাস। এই ইস্তাম্বুলের মেয়র থেকেই তুরস্কের ক্ষমতায় শীর্ষে পৌঁছান এরদোয়ান।
‘শূন্য শত্রুনীতিতে’ কি শেষরক্ষা হবে
চতুর রাজনীতিক এরদোয়ান যে পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না বিষয়টি তেমন নয়। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে দায়ী করে আসছেন তিনি। জাতীয়তাবাদী জিকির তুলে আপাতত জনগণকে ভুলিয়ে রাখারও চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসারও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এরদোয়ান। নিজের শুরুর সাফল্যের সময়কার ‘শূন্য শত্রু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে শূন্য সমস্যানীতিতে’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন তিনি।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে দেশটির ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে হত্যার পর টুকরো টুকরো দেহাবশেষ গুম করে দেওয়া হয়। নৃশংস এই খুনের জন্য পরোক্ষভাবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করেন এরদোয়ান। এ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। কিন্তু সম্প্রতি সেই সৌদি যুবরাজকে আঙ্কারায় লালগালিচা সংবর্ধনা দেন তিনি। রিজার্ভ–সংকটে থাকা তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সৌদি আরব ৫০০ কোটি ডলার জমা বা মুদ্রা বিনিময় হিসেবে রাখবে—এমন আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে দুই দেশের সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে।
আঞ্চলিক কূটনীতিতে এরদোয়ান সবচেয়ে বেশি বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদের। তাঁর সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন এরদোয়ান। বিনিময়ে তুরস্কে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে আমিরাত। ইসরায়েলে সম্প্রতি ক্ষমতায় এসেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় জোট। এরপরও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন এরদোয়ান। উদ্দেশ্য হলো—তুরস্কের ওপর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে ইসরায়েলের গ্যাস রপ্তানি থেকে সুবিধা নেওয়া। চীনের বিনিয়োগ টানতে ইউঘুর মুসলিম ইস্যুতেও এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন তিনি।
সর্বশেষ কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিসরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে হাত মেলান এরদোয়ান। অথচ বিরোধীদের ওপর নৃশংসতা চালানোয় একসময় সিসিকে ‘কসাই’ বলেছিলেন তিনি। আঞ্চলিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এই মরিয়া প্রচেষ্টা ‘নিজের ফেলে দেওয়া থুতু চেটে খাওয়ার’ মতোই। এরপরও আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেকোনো মূল্যে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে চান তিনি।
কিন্তু এত কিছুর পরও কূটনৈতিক সম্পর্কে কি আগের সেই আস্থা ফিরবে? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো উপেক্ষা করে শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থে ‘শূন্য শত্রুনীতিতে’ কি এরদোয়ানের শেষরক্ষা হবে? এ–যাত্রায় আধুনিক তুরস্কের ‘সুলতানের’ ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করছে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতার ওপর।
তথ্য সূত্র: আল-জাজিরা, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস