যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে বদল আনতে পারে হাড়ের নতুন পরীক্ষা
প্রাচীন হাড়ের ডিএনএ পরীক্ষার নতুন একটি পদ্ধতি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের কয়েকটি পর্যায় নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। গবেষকেরা এ কথা বলেছেন। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে বহু বছর ধরে ডিএনএতে ঘটে যাওয়া বড় পরিবর্তনের পথচিহ্ন শনাক্ত করতে সক্ষম। বিষয়টি জীব বা প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্ক জানতে-বুঝতে সহায়তা করছে।
এখন গবেষকেরা মাত্র কয়েক শ বছরের মধ্যে হওয়া ডিএনএর সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করতে পারেন। বিষয়টি বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন কীভাবে যুক্তরাজ্যে এসেছিল, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল, সে ব্যাপারে গবেষকদের বিভিন্ন সূত্র (ক্লু) দিচ্ছে।
গবেষকেরা যুক্তরাজ্যে পাওয়া মানুষের দেহাবশেষ বিশ্লেষণে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এই দেহাবশেষের মধ্যে সেই সময়কার নমুনাও রয়েছে, যখন রোমানদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল ইউরোপীয় অ্যাংলো-স্যাক্সন অভিজাতেরা।
যুক্তরাজ্যের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের নতুন ডিএনএ কৌশল উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছেন কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক পিটার হিথার। তিনি বলেন, ‘নতুন কৌশলটি বৈপ্লবিক হতে পারে।’
প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি প্রাচীন মানব–দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হবে। এসব মানুষ সাড়ে চার হাজার বছর আগে যুক্তরাজ্যে বসবাস করতেন।
গবেষকেরা গবেষণার জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে রোমান-পরবর্তী সময়কে বেছে নিয়েছেন। দেড় হাজার বছরের বেশি আগে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে লিখিত কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। যুক্তরাজ্যে অ্যাংলো-স্যাক্সন আক্রমণের মাত্রা ও প্রকৃতি বড় নাকি ছোট ছিল, প্রতিকূল নাকি সহযোগিতামূলক ছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
অধ্যাপক হিথার বলেন, পুরো ব্রিটিশ ইতিহাসের মধ্যে এই সময় পর্ব সবচেয়ে দ্বান্দ্বিক। তাই কাজ করার জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপারগুলোর একটি এটি। এই অধ্যাপক বলেন, অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা বোঝার সুযোগ করে দেবে নতুন এই পদ্ধতি। তারা কি সহযোগিতাপূর্ণ ছিল, সেখানে কি আন্তপ্রজননব্যবস্থা ছিল, স্থানীয় লোকজন কি অ্যাংলো-স্যাক্সন অভিজাতদের মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছিল—এমন সব বিষয় সম্পর্কে জানা যেতে পারে।
হাড় পরীক্ষার নতুন কৌশলটির নাম ‘টুইগস্ট্যাটস’। গবেষকেরা ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে পাওয়া বহু পুরোনো মানব–দেহাবশেষের ওপর পরীক্ষা চালানোর পর এই কৌশলের সাফল্য নিয়ে আশাবাদী।
স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে ভাইকিংদের বিস্তার সম্পর্কে গবেষকেরা ডিএনএ থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তার বেশির ভাগই ঐতিহাসিক রেকর্ডের সঙ্গে মিলে গেছে।
প্রসিদ্ধ নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে পরীক্ষা–কৌশলটি সফলভাবে কাজ করছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই গবেষণা স্বীকৃত তথ্যের ওপর নতুন করে আলোকপাতের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।
লিও স্পিডেল তাঁর দলের নেতা পনটাস স্কোগ্লান্ডের সঙ্গে মিলে কৌশলটি উদ্ভাবন করেছেন। স্পিডেল বলেন, উদ্ভাবনের মুহূর্তটিতে তাঁরা সত্যিই রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন যে মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁদের জানাশোনায় এই কৌশল সত্যিই পরিবর্তন আনতে পারে।
গবেষকেরা যে সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন, তা হলো, মানুষের জিনগত (জেনেটিক) কোড অনেক দীর্ঘ। ৩০০ কোটি পৃথক রাসায়নিক ইউনিট নিয়ে তা গঠিত। এই কোডে কয়েক প্রজন্ম ধরে ঘটা ছোট ছোট জিনগত পরিবর্তন চিহ্নিত করা অনেকটা খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মতো কঠিন কাজ।
গবেষকেরা সমস্যাটির সমাধান করেছেন খড়ের গাদা সরিয়ে নিয়ে সুইটি একদম চোখের সামনে রেখে। অর্থাৎ, তাঁরা পুরোনো জিনগত পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করে সেগুলো বাদ দিয়ে শুধু সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোয় মনোযোগ দেওয়ার উপায় খুঁজে পেয়েছেন।
গবেষকেরা একটি বৈজ্ঞানিক অনলাইন ডেটাবেজ থেকে হাজারো মানুষের দেহাবশেষের জিনগত তথ্য ছেঁকে বের করেছেন। তারপর হিসাব করে দেখেছেন যে এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি কতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ডিএনএর কোন অংশগুলো কোন দল থেকে ও কখন উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছে।
গবেষক পনটাস বলেন, যেসব মানুষের দেহাবশেষ বিশ্লেষণ করা হবে, তাঁদের প্রত্যেকের বলার মতো নিজস্ব গল্প আছে। আর শিগগির বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদেরা তাঁদের গল্প শুনতে সক্ষম হবেন।
পনটাস আরও বলেন, তাঁরা ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কে বুঝতে চান। রোমান আমল, অ্যাংলো-স্যাক্সনদের আগমন—এসব সময় সম্পর্ক তাঁরা জানতে চান। তাঁরা দেখতে চান, কীভাবে এটি বিশ্বের এই অংশের পূর্বপুরুষ ও বৈচিত্র্যকে আকার দিয়েছিল।
বিভিন্ন জনসংখ্যার সঙ্গে আন্তপ্রজনন দেখানোর পাশাপাশি মহামারি, খাদ্যের পরিবর্তন, নগরায়ণ, শিল্পায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্ত-ঘটনা কীভাবে মানুষ মোকাবিলা করেছে, তার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিবরণ প্রাচীন ডিএনএতে আছে।
হাড় পরীক্ষার নতুন কৌশলটি সম্ভাব্যভাবে বিশ্বের যেকোনো অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সেখানে, যেখানে ভালোভাবে সংরক্ষিত মানব–দেহাবশেষের একটি বড় সংগ্রহ রয়েছে।
অধ্যাপক হিথার ইউরোপের ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় রহস্যের’ উত্তর খুঁজতে নতুন এই কৌশল ব্যবহার করতে চান। আর তা হলো, দেড় হাজার বছর আগে কেন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ জার্মান ভাষাভাষী থেকে স্লাভিক ভাষাভাষীতে পরিবর্তিত হয়েছিল।