জেলেনস্কির সঙ্গে বন্ধুত্বে বরিসকে কি ছাড়িয়ে যেতে পারবেন ট্রাস
লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে লন্ডনের অবস্থান এখন কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
এত দিন ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাজ্য যেভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেটাই কি অব্যাহত থাকবে? নাকি কমবে? নাকি কিয়েভের প্রতি লন্ডনের সমর্থন আরও জোরদার হবে?—এসব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর জানতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ট্রাস মস্কো যান। তখন তিনি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাশিয়া যাতে ইউক্রেনে হামলা না করে, সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মস্কো গিয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাস। এই বৈঠকে তিনি ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখো সেনা সমাবেশের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করেন। বৈঠকে ট্রাসের নানা মন্তব্যে তাঁর ওপর বেশ রুষ্ট হয় ক্রেমলিন। তখন থেকেই ট্রাসকে প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসছে ক্রেমলিন।
২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। এই ঘটনায় পুতিনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন ট্রাস। গত মার্চ মাসে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, পুতিনকে অবশ্যই ইউক্রেনে হারাতে হবে। পুতিনের আত্মীয়সহ অনেক রুশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন।
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে ট্রাস ঘোষণা দেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হতে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের দৌড়ে জয়ী হলে প্রথম যে বিশ্বনেতাকে ফোন দেবেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
একই সঙ্গে ট্রাস ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি হবেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তিনি বরিস জনসনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যাতে ইউক্রেনে ব্যর্থ হন, একটি কৌশলগত পরাজয় ভোগ করেন, ভবিষ্যতে রাশিয়া যাতে সংযত আচরণ করতে বাধ্য হয়, তা নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের শর্তাবলির অধীনে ইউক্রেনকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা চালিয়ে যেতে হবে বলেও মত দিয়েছিলেন ট্রাস।
৫ সেপ্টেম্বর ঋষি সুনাককে হারিয়ে দলের নেতা হন ট্রাস। ৬ সেপ্টেম্বর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। যুক্তরাজ্যের নতুন ‘আয়রন লেডি’ ট্রাসের বিজয় ঘোষণার খবরকে আনন্দের সঙ্গে স্বাগত জানায় ইউক্রেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়াকে ব্যর্থ করতে ট্রাস কিয়েভকে সহায়তা করবেন বলে আশা করেন।
অন্যদিকে ট্রাসের ব্যাপারে আগেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায় ক্রেমলিন। তাঁর জয় ঘোষণার প্রাক্কালে রুশ প্রেসিডেন্টের প্রধান মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ট্রাসের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হলে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়, মূর্খতা জয়ী হয়েছে। বরিস ব্রেক্সিট অর্জন করেছেন। তাঁর উত্তরসূরি ট্রাস সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু অর্জন করতে চান। আর তা হলো, বিশ্বের বিনাশ।
যুক্তরাজ্যের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বরিস ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অন্যতম বড় সমর্থক। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ে কিয়েভকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ইউক্রেনে ভারী অস্ত্র পাঠানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তিনি যুদ্ধের মধ্যেই তিনবার ইউক্রেন সফর করেন।
বরিসের সমালোচকেরা অবশ্য তখন বলেছিলেন যে তিনি তাঁর ঘরোয়া কেলেঙ্কারি ঢাকতে, জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘোরাতে ইউক্রেনের পক্ষে তাঁর জোর সমর্থনের বিষয়টিকে ব্যবহার করেছিলেন।
ট্রাসও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজ দেশে জনপ্রিয় না–ও হতে পারেন। কারণ, এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের জনগণের মাত্র ১২ শতাংশ মনে করে যে তিনি একজন ভালো বা মহান প্রধানমন্ত্রী হবেন। অন্যদিকে ৫২ শতাংশ জনগণ মনে করে, তিনি খারাপ বা খুব খারাপ প্রধানমন্ত্রী হবেন।
ট্রাস কতটা দক্ষতার সঙ্গে দেশ চালাতে পারবেন, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ আছে। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে তাঁর অবস্থান যে অবিচল থাকবে, তা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই।
কিয়েভ ইনডিপেনডেন্টের সাংবাদিক ইগর কসভের মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের অবস্থান শুরু থেকেই কঠোর। ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় যুক্তরাজ্যের এই মনোভাবের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
একই মত ইউক্রেনীয় থিঙ্কট্যাংক অ্যাডাস্ট্রারের সিনিয়র ফেলো বোহদান মাইরোনেঙ্কোর। তিনি বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, ট্রাসের নেতৃত্ব ইউক্রেন ও তার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর হবে না।’
ট্রাসের নেতৃত্বে জেলেনস্কির প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন দ্বিগুণ হতে পারে বলে মনে করেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার লন্ডন ব্যুরোর প্রধান মার্ক ল্যান্ডলার। তাঁর মতে, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাজ্যের আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য আসবে আরও অস্ত্র।
তবে ইউক্রেনে সেনা পাঠাবেন না ট্রাস। তিনি গত জুলাইয়ের শেষ দিকে জানিয়েছিলেন, ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত দেশ নয়। তাই দেশটিতে সরাসরি ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন হবে ভুল।
যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু চায় ইউক্রেন। কিয়েভের এই চাওয়া ট্রাস কতটা পূরণ করতে পারবেন, তার অনেকটা নির্ভর করবে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ওপর। কারণ, যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট দেশটির সম্ভাব্য বিকল্পগুলোকে সীমিত করে দিতে পারে।
থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান রিফর্মের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক পরিচালক ইয়ান বন্ডের মতে, ট্রাসের একটি সমস্যা আছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন। কেননা, তিনি সবকিছুকে অগ্রাধিকার দিতে পারবেন না।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, নিউজউইক, কিয়েভ ইনডিপেনডেন্ট।