রাশিয়ায় ইউক্রেনের যত ড্রোন হামলা
‘ধীরে ধীরে যুদ্ধ রাশিয়ার সীমান্তে ফিরছে। তার প্রতীকী কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিগুলোয় এই যুদ্ধ ফিরছে। এটা অবশ্যম্ভাবী, স্বাভাবিক ও পুরোপুরি ন্যায়সংগত’— রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় ড্রোন হামলার প্রতি ইঙ্গিত করে গতকাল রোববার কথাগুলো বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
এর আগে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রোববার ইউক্রেনের তিনটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে তারা। দুটি ড্রোন অফিস ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে। এ হামলার কারণে মস্কোর কেন্দ্রস্থল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের ভনুকোভো বিমানবন্দর ঘণ্টাখানেকের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
ইউক্রেন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ার ভূখণ্ডে দফায় দফায় ড্রোন চালিয়ে আসছে। কয়েকটি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ কথা বলা হচ্ছে।
ড্রোন হামলার কারণে ৪ জুলাই মস্কোর ভনুকোভো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কয়েকটি ফ্লাইট নিকটবর্তী বিমানবন্দরে অবতরণে বাধ্য হয়েছে।
গত ৩ মে ক্রেমলিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা হয়। এ ঘটনার পর ইউক্রেন পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে মস্কো। তবে ইউক্রেন ওই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
যত ড্রোন হামলা
বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভ্যারিফাই’ ৫ জুলাই নাগাদ রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের রুশ নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে চলতি বছরের ১২০টির বেশি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ড্রোন হামলার অধিকাংশই ছিল ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক ও বেলগোরোদ অঞ্চলে। পাশাপাশি রাশিয়ার ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপেও হামলা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মস্কো অঞ্চলেও দফায় দফায় ড্রোন হামলা হয়েছে। গত ৩০ মে এক দফা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েকটি ভবন। এ ধরনের হামলা চালানোর কথা অবশ্য অস্বীকার করে আসছে ইউক্রেন।
রাশিয়া জানিয়েছে, ৪ জুলাই মস্কোর বিস্তৃত অঞ্চলে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পাঁচটি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। তেলক্ষেত্র, বিমানঘাঁটি ও জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়।
তেল মজুতের স্থাপনায় অন্তত নয়টি হামলা শনাক্ত করেছে বিবিসি ভ্যারিফাই। এ ধরনেরই একটি হামলা চালানো হয়েছিল ক্রিমিয়ার অন্যতম বড় শহর সেভাস্তোপোলে। গত ২৯ এপ্রিলের ওই হামলায় তেলের কয়েকটি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়।
ক্রিমিয়ার সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় ভূখণ্ড ক্রাসনোদারে একটি তেল শোধনাগারে গত ৩১ মে আগুন ধরে যায়। সম্ভাব্য ড্রোন হামলা থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিলেন আঞ্চলিক গভর্নর।
নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিবিলাইন-এর বিশ্লেষক লায়লা গেস্ট বলছেন, পাল্টা আক্রমণ ঘিরে নিজেদের কৌশলের অংশ হিসেবে সরবরাহ ব্যবস্থায় সর্বাধিক বিঘ্ন সৃষ্টিতে তেল শোধনাগার, সেইসঙ্গে রেলওয়ে অবকাঠামো এবং রাশিয়ার বিস্তৃত যুদ্ধসরাঞ্জামকে লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রাধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
গত ফেব্রুয়ারিতে মস্কোর ১০০ কিলোমিটার দূরে একটি ড্রোন বিধ্বস্ত হয়। স্থানীয় গভর্নর বলেছিলেন, এটা ছিল বেসামরিক স্থাপনায় হামলার প্রচেষ্টারই অংশ।
ড্রোনটির ধ্বংসাবশেষের ছবির সঙ্গে ইউজে-২২ ড্রোনের মিল আছে। ইউক্রেন এ ধরনের ড্রোন বানিয়ে থাকে। স্বচালিত উড্ডয়নে এই ড্রোনের পাল্লা ৮০০ কিলোমিটার। তবে সরাসরি নিয়ন্ত্রিত উড্ডয়নের ক্ষেত্রে এর পাল্লা অনেক কম।
গত ১০ মে ভোরোনেঝ অঞ্চলের একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সম্ভাব্য আরেকটি ড্রোন হামলায় ১০ রুশ সেনা আহত হন। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিনজন নিহত হন।
কত দূরে হামলায় সক্ষম ইউক্রেনীয় ড্রোন
এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই ড্রোন ব্যবহার করছে। ইউক্রেনের ভেতরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে ইরানের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া।
ইউক্রেন বলছে, সম্মুখ যুদ্ধে চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশটি ড্রোন উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এসব ড্রোন কত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন থেকে উড্ডয়ন করা ড্রোনগুলো রুশ ভূখণ্ডের অনেক ভেতরে পৌঁছাতে পারে। এমনকি মস্কো পর্যন্ত, যে শহরটি ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার ভেতরে।
অ্যাভিয়েশনিস্ট ব্লগের সম্পাদক ডেভিড সেনসিয়ট্টি বলছেন, ‘যদিও ইউক্রেন নিশ্চিত করেনি দেশটির সশস্ত্র বাহিনী মস্কোতে হামলা চালিয়েছে, তবে আমি মনে করি, গত বছর আমাদের দেখা আগ বাড়িয়ে চালানো অভিযানগুলো প্রমাণ করে ইউক্রেনের ভূখণ্ডের মধ্যে থেকেই এ ধরনের দূরপাল্লার আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা রাখে ইউক্রেন।’
ড্রোন বিশেষজ্ঞ স্টিভ রাইটও বলেছেন, ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে উড্ডয়ন করানো একটি ড্রোনের ক্রেমলিনে আঘাত হানা সম্ভব। তবে তিনি বলেন, ‘আমরা ধারণা ওই ড্রোন আরও কাছ থেকে উড্ডয়ন করানো হয়েছিল, যাতে এটি মস্কোর অধিকাংশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঝুঁকি এড়াতে পারে।’
ইউক্রেনের ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন মন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরভ সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেনের আর-১৮ ড্রোন কিয়েভ থেকে উড্ডয়ন করে মস্কো গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। তবে মস্কোয় হামলার আহ্বান জানানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
সেনসিয়ট্টি বলেন, কয়েকটি ড্রোন বেশকিছু উদ্দেশে ব্যবহার করেছে ইউক্রেন। বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন ইউক্রেনের জন্য আকাশযুদ্ধের আসল তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এসব ক্ষয়ক্ষতির কিছু ভিডিও অনলাইনে প্রচার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেনের কাছে কয়েকটি বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন বিক্রি করেছে তুরস্ক। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই ড্রোন কেনার জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হলে তুরস্কের এই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ড্রোন অনুদান হিসেবে দেয়।