জার্মান সেনাবাহিনী কি যুদ্ধ করতে অক্ষম
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর জার্মান নেতারা সামরিক বাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করে ন্যাটোতে অগ্রণী ভূমিকা পালনের সংকল্প ব্যক্ত করেন। তবে সর্বাধুনিক সব পুমা ট্যাংক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছে জার্মান সেনাবাহিনী।
গত সোমবার একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, জার্মানির অন্যতম প্রধান সমরাস্ত্র পুমা ট্যাংক এক প্রশিক্ষণ মহড়ায় অংশ নেওয়ার পর এর একটিও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
এটা চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ও বিশেষ করে তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টিনা লামব্রেশটের অব্যবস্থাপনার প্রমাণ বলে সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।
খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউর সংসদীয় দলের নেতা ইয়োহান ভাদেফুল গণমাধ্যমকে বলেন ‘এটি একটি দুঃস্বপ্ন’। তিনি বলেন, ‘পুমা জার্মান সেনাবাহিনীর এক প্রধান অস্ত্র বলে মনে করা হয়। যদি পুমা কার্যকর না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীও কার্যকর নয়।’
সোমবার এক বিবৃতিতে লামব্রেশট বলেন, ‘যুদ্ধে আমাদের সৈন্যরা অবশ্যই শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অস্ত্রের উপর নির্ভর করতে সক্ষম হবে।’
পুমা ট্যাংক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও এটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন পরিকল্পনা মোতাবেক পুরনো মারডার ট্যাংকগুলো আপাতত ন্যাটোর মহড়ায় ব্যবহার করা হবে বলে তিনি জানান৷
পুমা ট্যাংকের জটিল মডেল তৈরিতে ১২ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। একেকটি ট্যাংক তৈরিতে খরচ পড়ে ১৭ মিলিয়ন ইউরো। পুরাতন মারডার ট্যাংকের পরিবর্তে পুমা ব্যবহার করার কথা ছিল। জার্মানি সেনাবাহিনী সেই সত্তরের দশক থেকে মারডার ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে।
কিন্তু যান্ত্রিক ক্রটিসহ পুমা ট্যাংকে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ২০১৫ সালে তৈরি করা হলেও এর সবগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিটি ন্যাটো সদস্যের অন্তত ৩০ দিনের গোলাবারুদ থাকতে হবে। এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জার্মানিকে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করতে হবে।
ফুরিয়ে যাচ্ছে গোলাবারুদ
সম্প্রতি জার্মান সেনাবাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে দেশটির গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি উদ্বেগজনক শিরোনাম হয়। তবে এর মধ্যে পুমা ট্যাংকের বিপর্যয় সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়।
জার্মান সেনাবাহিনীর কাছে মাত্র দুদিন তীব্র লড়াইয়ের পর্যাপ্ত গোলাবারুদ রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি সূত্র এই তথ্য ফাঁস করেছে বলে জানা যায়।
এই খবর যদি সত্যি হয়, তাহলে জার্মান সেনাবাহিনী গোলাবারুদ সরবরাহে ন্যাটোর বেধে দেয়া মানদণ্ডের অনেক নিচে অবস্থান করছে।
প্রতিটি ন্যাটো সদস্যের অন্তত ৩০ দিনের গোলাবারুদ থাকতে হবে। এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জার্মানিকে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করতে হবে।
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর জার্মান চ্যান্সেলর দেশটির বৈদেশিক নীতি ও সামরিক কৌশলে আমূল পরিবর্তন আনবেন বলে ঘোষণা দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কথার প্রমাণ রাখতে ওলাফ শলৎস বিশাল অংকের প্রতিরক্ষা বাজেট অনুমোদন করেন। এ ছাড়াও সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণে ১০০ বিলিয়নের বিশেষ তহবিল গঠন করেন।
দোষারোপের খেলা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ৯ মাসের মাথায় অনেকে অবাক হচ্ছেন যে এত মোটা অংকের জার্মান সামরিক বাজেট কোথায় খরচ হলো।
গোলাবারুদ নিয়ে কেলেঙ্কারি মধ্যে এই সমস্যা সমাধানে কে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করবে তা নিয়ে সরকার ও জার্মানির প্রতিরক্ষা শিল্পের মধ্যে একটি জঘন্য রকমের বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছে। সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রতিরক্ষা শিল্প আগে পদক্ষেপ নিবে নাকি এ নিয়ে সরকারের অতিদ্রুত আদেশ দেওয়া উচিত ছিল।
শলৎসের মধ্য-বাম সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির নেতা লার্স ক্লিংবাইল ডিসেম্বরের শুরুতে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি সামরিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলোর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
লার্স ক্লিংবাইলের মতে, ‘দেখি রাজনীতিবিদেরা আমাদের কী প্রস্তাব করেন, এমন মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে সামরিক ঘাটতিগুলো কমানো যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি জার্মান শিল্প ঘাটতি পূরণ করতে না পারে তাহলে আমাদের দেখতে হবে বিদেশ থেকে অথবা ন্যাটো অংশীদারদের কাছ থেকে কিনতে পারি কিনা।’
জার্মান নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা শিল্প সমিতি বিডিএসভির প্রধান হ্যান্স ক্রিস্টফ আৎসপোডিয়ান ক্লিংবাইলের বক্তব্যকে ‘ভুল’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ডিপিএকে বলেছেন যে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জার্মানির বড় অস্ত্র কোম্পানিগুলো তাদের সক্ষমতা দ্বিগুণ করেছে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর)-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাফায়েল লস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রতিরক্ষা শিল্প ও সরকারের মধ্যে যে নাটক করা হচ্ছে তা হাস্যকর’ এই বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া জানার ক্ষেত্রে জার্মানির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রাফায়েল লস বলেন, ‘অন্যান্য দেশগুলো, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ সরকার ও শিল্পের মধ্যে প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরিতে অনেক দ্রুত এগিয়েছে।’
ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ইউরোপের ন্যাটো অংশীদাররা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, সংকটকালে সামরিক অংশীদার হিসেবে জার্মানির উপর নির্ভর করা যায় না।
আপনি চাইলেই কোনো গুদামের তাক থেকে কিছু সিস্টেম (যুদ্ধযন্ত্র) কিনতে পারবেন না।ক্রিস্টিনা লামব্রেশট, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জার্মানি
ক্রয় শুরু
শলৎসের অধীনে জার্মানি ২০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ৩৫টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তবে সামরিক ক্রয় সবসময় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। কেননা, সামরিক বাহিনী যা ব্যবহার করে তার প্রায় সবকিছুই ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর তৈরি করা হয়। অন্যান্য পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়।
সম্প্রতি সংসদের বাজেট বিতর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টিনা লামব্রেশট বলেন, ‘ আপনি চাইলেই কোনো গুদামের তাক থেকে কিছু সিস্টেম (যুদ্ধযন্ত্র) কিনতে পারবেন না।’