শান্তির লক্ষ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন ম্যার্কেল
জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা করতে এবং মস্কোর সঙ্গে শান্তি টিকিয়ে রাখতে গ্যাস চুক্তি করার কথা বলেছেন সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। বিবিসি বার্লিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
ম্যার্কেল বলেন, ২০০৮ সালে তিনি কিয়েভকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আটকে দিয়েছিলেন। তিনি এ পদক্ষেপ না নিলে আরও আগেই ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
জার্মানিতে ১৬ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যার্কেল। তিনি যখন জার্মানির নেতৃত্ব দিয়েছেন, তখন দেশটিকে অর্থনৈতিক সংকট, অভিবাসী সংকট ও ২০১৪ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার মতো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
ম্যার্কেল কি মস্কোর প্রতি বেশি নমনীয় ছিলেন? কিয়েভকে সহায়তায় বেশি দেরি করেছিলেন? তিনি যদি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিরোধিতা না করতেন, তবে এখন কি যুদ্ধ হতো? এসব প্রশ্নের উত্তরে ম্যার্কেল নিজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
ম্যার্কেল বলেন, ন্যাটো সদস্য হওয়ার পথে যদি ইউক্রেন এগিয়ে যেত, তবে আরও আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। তিনি বলেন, ‘আমরা আরও আগেই সামরিক সংঘাত দেখতে পেতাম। এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দেখে প্রেসিডেন্ট পুতিন অলস বসে থেকে দেখতেন না। তখন ইউক্রেন এতটা প্রস্তুত ছিল না, যতটা তারা ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর সময় দেখাতে পেরেছিল।
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের এ কথা মানতে নারাজ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার ব্যাপারে ম্যার্কেলের সিদ্ধান্ত ও তখনকার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির সমর্থনকে স্পষ্ট ভুল হিসাব বলে মন্তব্য করেছেন।
তিন বছর আগে ক্ষমতা ছাড়ার পর ম্যার্কেল বিরল এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিবিসিকে। তিনি পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নতুন হুমকি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
পুতিন ও ম্যার্কেলের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় ধরে জানাশোনা রয়েছে। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু করব।’
ম্যার্কেল আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে এ নিয়ে চীনও কথা বলেছে। আমরা ভয়ে অথর্ব হয়ে থাকব না। আমরা অবশ্যই মেনে নেব যে রাশিয়া সবচেয়ে বড় বা যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্বের দুই পারমাণবিক পরাশক্তির একটি দেশ। তাদের সম্ভাবনা ভীতিকর।’
দায়িত্বে থাকার সময় ম্যার্কেল অধিকাংশ সময় জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি অনেকটাই নিজের সিদ্ধান্তগুলোর পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সম্প্রতি নিজের আত্মজীবনী ‘ফ্রিডম’ প্রকাশ করেছেন ম্যার্কেল। তাঁর এই বই প্রকাশের সময়টা বেশ আকর্ষণীয়। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে শান্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে তিনি সহযোগিতা করে গেছেন। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার কয়েক মাস পর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে।
ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যাটিও রেনজি বলেন, বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের প্রধান হিসেবে ম্যার্কেলই কার্যত ইউরোপের নেতা ছিলেন। তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘বস’ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘স্মরণ করতে পারেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলতে ইউরোপের টেলিফোন নম্বর কত? আমার স্পষ্ট উত্তর ছিল, অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের মোবাইল নম্বর।’
ম্যাটিও রেনজি আরও বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে ম্যার্কেলের সম্পর্কের জন্য কেউ তাঁকে আক্রমণ করতে পারেন না। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে ইউরোপের সবার লক্ষ্য ছিল এক, তা কেবল ম্যার্কেলের একার লক্ষ্য ছিল না।
ম্যার্কেলের সময় জার্মানির বড় শিল্পগুলো মস্কোর ওপর জ্বালানির জন্য নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। জার্মানি তখন রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত দুটি গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, সস্তার গ্যাসকে ক্রেমলিনের ভূতাত্ত্বিক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করেছে ক্রেমলিন। ম্যার্কেল বলেন, তিনি দুটি উদ্দেশে এ পাইপলাইন করেছিলেন। তা হচ্ছে জার্মানির ব্যবসায়িক স্বার্থ ও রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রাখা। তবে ইইউ ও ন্যাটো সদস্যরা তাঁর সঙ্গে একমত নয়। পোল্যান্ডের সংসদ সদস্য র্যাডোসল ফোগিয়েল অভিযোগ করেন, জার্মানির গ্যাসের অর্থ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণে ব্যবহার করছে।
ম্যার্কেলের যুক্তি, তিনি কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়ার আক্রমণ থামানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।
ম্যার্কেল অভিযোগ করেন, ইউক্রেনে হামলার পর থেকে ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইতালি যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
আঙ্গেলা ম্যার্কেল নিজের দেশ ও এর অর্থনীতির বিষয়টিকে সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর বিরুদ্ধে নিজের দেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংকট জিইয়ে রাখার ও ইইউর ভবিষ্যৎ-প্রমাণে সুদূরপ্রসারী সংস্কার করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জার্মানিকে এখন ইউরোপের ‘রুগ্ণ ব্যক্তি’ তকমা দেওয়া হয়। বিশ্বমঞ্চে একসময় রপ্তানির ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে হিসেবে পরিচিত জার্মানি এখন মন্দার কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। ভোটারদের অভিযোগ, ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট রাখতে গিয়ে ম্যার্কেল সড়ক, রেল ও ডিজিটাইলাইজেশনে বিনিয়োগে ব্যর্থ হয়েছেন।
ম্যার্কেলের সময় জার্মানি ছাড়াও জ্বালানির জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন ম্যার্কেল। ওই সিদ্ধান্তগুলো সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।
সামনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে এসে আমদানিতে শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছেন। প্রথম দফার ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি জার্মানিতে প্রতিরক্ষায় বাজেট বাড়াতে বলেছিলেন। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতিও ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে ইউরোপ ক্ষুব্ধ হয়। ওই পরিস্থিতি ইউরোপে এখনো অপরিবর্তিত।