ইউক্রেনে নিজেদের দখলে থাকা এলাকাগুলো রক্ষায় রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পিছপা হবে না বলে গত বৃহস্পতিবার বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ।
এর আগের দিনই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতা’ হুমকিতে পড়লে পারমাণবিক বোমা মারার প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন। এতে নড়েচড়ে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্ররা। কীভাবে তারা এর জবাব দেবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলাপ–আলোচনা।
বিশেষজ্ঞরা এটা মনে করেন না যে রাশিয়ার নেতা পুতিন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবেন। তবে তাঁরা বলেন, বাস্তব ক্ষেত্রে এমন সম্ভাব্য দৃশ্যপট রয়েছে, যা এ ধরনের বোমা ব্যবহারের সম্ভাবনাকে খুলে দিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন গত বুধবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বলেন, তাঁর দেশের ভূখণ্ড হুমকিতে পড়লে পারমাণবিক বোমার (সম্ভাব্য) ব্যবহার নিয়ে তিনি কোনো ধাপ্পাবাজি করছেন না। তিনি এমন একটি সময় এসব কথা বলেন, যখন ইউক্রেনে লড়াই করতে নতুন করে আংশিক সেনা সমাবেশ ঘটানোর ঘোষণা দেন তিনি। এর ফলে দেশটিতে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা পাঠাতে পারে মস্কো।
‘যারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে তাদের জেনে রাখা উচিত, হাওয়া তাদের দিকে ঘুরে যেতে পারে। এটা কোনো ধাপ্পাবাজি নয়।’ বলেন, পুতিন।
বিশ্লেষকেরা এটা মনে করেন না যে ১৯৪৫ সালে জাপানের দুই শহরে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত পুতিন প্রথম কোনো ব্যক্তি হতে চাইবেন, যাঁর নির্দেশে এই বোমা আবার ফেলা হবে।
যে সম্ভাব্য দৃশ্যপটে রাশিয়া পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে, তা নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে কথা বলেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা।
কেমন হতে পারে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা
বিশ্লেষকেরা বলেন, পারমাণবিক হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি হলে মস্কো এক বা একাধিক ‘ট্যাকটিক্যাল’ বা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী পারমাণবিক বোমা প্রস্তুত রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১ দশমিক ২ মেগা টনের সবচেয়ে বড় ‘স্ট্র্যাটেজিক’ যুদ্ধাস্ত্র বা ১৯৬১ সালে রাশিয়ার পরীক্ষা চালানো ৫৮ মেগা টনের বোমার সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তবে ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক বোমা সেই মারণাস্ত্র, যা শূন্য দশমিক ৩ কিলো টন থেকে ১০০ কিলো টনের বিস্ফোরক শক্তিসম্পন্ন।
বিশ্লেষকেরা বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করলে এর লক্ষ্য হবে, দেশটিকে আত্মসমর্পণ করা বা সমঝোতায় আসার জন্য ভয় দেখানো এবং দেশটিকে সমর্থন করা পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি।
ট্যাকটিক্যাল বোমার নকশা এমনভাবে করা হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে যার প্রভাব থাকে সীমিত। অপর দিকে সর্বাত্মক লড়াই পরিচালনা ও জেতার লক্ষ্য নিয়েই তৈরি করা হয় স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্র।
তবে ‘ক্ষুদ্র’ ও ‘সীমিত’ এ শব্দগুলো আপেক্ষিক। যেমন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরে যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, তা ছিল মাত্র ১৫ কিলো টনের। কিন্তু এর প্রভাব ছিল প্রলয়ংকরী।
মস্কোর লক্ষ্যবস্তু যা হতে পারে
বিশ্লেষকেরা বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করলে এর লক্ষ্য হবে, দেশটিকে আত্মসমর্পণ করা বা সমঝোতায় আসার জন্য ভয় দেখানো এবং দেশটিকে সমর্থন করা পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি।
মার্ক ক্যানসিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) সামরিক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, সম্ভবত সম্মুখ সমরে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করবে না রাশিয়া।
একাধিক পারমাণবিক বোমা ফেলার জন্য রাশিয়ার ২০ মাইল (৩২ কিলোমিটার) এলাকার দখল প্রয়োজন হতে পারে। এর কম জায়গা হবে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
(রাশিয়ার লক্ষ্য অর্জনে) শুধু একটি পারমাণবিক বোমা ফেলা যথেষ্ট হবে না, বলেন ক্যানসিয়ান।
প্রেসিডেন্ট পুতিন গত বুধবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বলেন, তাঁর দেশের ভূখণ্ড হুমকিতে পড়লে পারমাণবিক বোমার (সম্ভাব্য) ব্যবহার নিয়ে তিনি কোনো ধাপ্পাবাজি করছেন না।
স্থলভাগে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর পরিবর্তে মস্কো ইউক্রেনের কাছে শক্ত বার্তা পৌঁছাতে ও উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জলভাগের ওপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। অথবা ইউক্রেনের অনেক ওপরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে মস্কো; যাতে দেশটির ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম অকেজো হয় পড়ে।
এসব সম্ভাবনার বাইরে পুতিন ইউক্রেনের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালানোকে বেছে নিতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ শহরাঞ্চলে হামলা চালানোরও; যাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ও সম্ভবত দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শেষ করা যায়।
হোয়াইট হাউসের সাবেক পরমাণু নীতি বিশেষজ্ঞ জন উলফসথল যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাবস্ট্যাককে বলেন, সম্ভবত এমন দৃশ্যের অবতারণা করা হবে; যাতে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো ও পুতিনবিরোধী বৈশ্বিক ঐকমত্যে চিড় ধরে।
কেমন হবে পশ্চিমা দেশগুলোর সাড়া
রাশিয়া কৌশলগত পারমাণবিক হামলা চালালে এর জবাব কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। আর তাদের সামনে থাকা বিকল্পগুলোও বেশ জটিল।
পারমাণবিক বোমা হামলা নিয়ে পুতিনের এই চাপা হুমকির কাছে নিজেদের দুর্বল হিসেবে দেখাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো। তবে ইউক্রেনে এমন কোনো যুদ্ধের আশঙ্কা তারা এড়াতেও চাইবে; যদিও দেশটি ন্যাটোর সদস্য নয়। এটা না হলে তা যুদ্ধের আরও বিস্তার ঘটাতে, এমনকি বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়কর পারমাণবিক যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে পারমাণবিক হামলা চালালে এর জবাব না দেওয়ার কোনো বিকল্প থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের কাছে। এই জবাব আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষ থেকে নয়; বরং জোট হিসেবে ন্যাটোর কাছ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে তার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ১০০টি মোতায়েন করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে এসব ব্যবহারও হতে পারে।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের ম্যাথু ক্রোনিগের মতে, রাশিয়াকে পাল্টা জবাব দেওয়ার এ হুমকি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সংকল্পকে প্রতিফলিত করছে; সেই সঙ্গে মস্কোকে তার কর্মকাণ্ডের পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
তবে ক্রোনিগ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের তৎপরতা রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব উসকে দিতে এবং বৃহত্তর পরিসরে পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই ও আরও মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ইউক্রেনকে আরও শক্তিশালী অস্ত্র দেওয়া কি উচিত
রাশিয়া পারমাণবিক হামলা চালালে পশ্চিমা দেশগুলোর আরও প্রচলিত সামরিক বা কূটনৈতিক পন্থায় জবাব দেওয়া ও মস্কোয় হামলার জন্য ইউক্রেনকে অধিকতর মারণাস্ত্র সরবরাহ করাই হবে বেশি কার্যকর, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ক্রোনিগ বলেন, ভারতের মতো যেসব দেশ এখন পর্যন্ত চলমান সংঘাতে জড়াতে অনিচ্ছুক তাদের ও সম্ভবত চীনকেও মস্কোর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান নিষেধাজ্ঞায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার পথ খুলে দিতে পারে রাশিয়ার পারমাণবিক হামলা।
উপরন্তু, ন্যাটোর যুদ্ধবিমান, প্যাট্রিয়ট ও থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যাটারি, দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলো ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার একেবারে ভেতরে ব্যবহার করতে পারে তা ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।