পুতিনের সেনা সমাবেশের ঘোষণা নিয়ে যা বললেন বিভিন্ন দেশের নেতারা

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মস্কো, রাশিয়া, ২১ সেপ্টেম্বর
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আংশিকভাবে সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম রাশিয়া এ ধরনের সেনা সমাবেশ করতে যাচ্ছে। স্থানীয় সময় বুধবার এ ঘোষণার সঙ্গে পুতিন আরও সতর্ক করেছেন, তাঁর পদক্ষেপ কোনো ‘ধাপ্পাবাজি’ হবে না।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে পুতিন বলেছেন, পশ্চিমারা পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছে। এর জবাব দেওয়ার জন্য মস্কোর হাতে প্রচুর অস্ত্রের মজুত রয়েছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানিয়েছেন, পুতিনের এই আদেশের ফলে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ভূমিকা রাখার জন্য বাড়তি তিন লাখ সেনাকে ডাকা হবে। অতীত সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে—এমন ব্যক্তিদের এখানে ডাকা হবে। পুতিনের ঘোষণা ইউক্রেন সংঘাত বাড়িয়ে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সেনা সমাবেশের এমন ঘোষণার পর ইউক্রেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সেসব প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো।

ইউক্রেন

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দেবে—এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। একই সঙ্গে তিনি রুশ বাহিনী ইউক্রেনের যেসব ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে, সেসব ভূখণ্ড দখলদারমুক্ত করার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।  

জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না তিনি (পুতিন) এসব অস্ত্র ব্যবহার করবেন। বিশ্ব তাঁকে এসব অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ দেবে বলেও আমার মনে হয় না। পুতিন আগামীকাল বলতে পারেন, “ইউক্রেন ছাড়া আমরা পোল্যান্ডের একটা অংশ চাই, না হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করব।” আমরা এসব মানতে পারি না।’

যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার ক্রমাগত ব্যর্থতার মুখে পুতিন সেনা সমাবেশের এ ঘোষণা দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তিনি (পুতিন) এখন দেখছেন তাঁর সেনারা সোজা পালিয়ে যাচ্ছে। তাই তো এখন তিনি (পুতিন) তাঁর দেশের সেনাদের রক্তসহ সারা ইউক্রেনকে রক্তে ডুবিয়ে দিতে চান।’

ন্যাটো

ন্যাটোর প্রধান ইয়েনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, পুতিনের সেনা সমাবেশের ঘোষণা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে একটি ‘বিপজ্জনক ও বেপরোয়া’ পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন এই সামরিক জোটের প্রধান সতর্ক করে বলেন, ‘আরও সেনা সমাবেশ ঘটালে এতে করে ইউক্রেনে চলমান সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়বে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের গুরুতর পরিণতি নিয়ে মস্কোর যেন কোনো ভুল–বোঝাবুঝি না হয়, সেটা নিশ্চিত করবে ন্যাটো।’    

তিনি আরও বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে আমরা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাব, সে বিষয়ে মস্কোর যাতে কোনো ভুল ধারণা না থাকে, সেটা নিশ্চিত করব আমরা। তবে এটা নির্ভর করবে তারা (রাশিয়া) কোন ধরনের পরিস্থিতিতে কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করবে, তার ওপর।’    

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি জিলিয়ান কিগান বলেছেন, ‘পুতিনের এই ভাষণ ইউক্রেনের যুদ্ধে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। তাঁর এই হুমকি অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।’

কিগান বলেন, ‘স্পষ্টতই এটা এমন একটা বিষয়, যেটা আমাদের অনেক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। কারণ আপনি জানেন, আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আসলে তিনি (পুতিন) নিজেও স্বাভাবিক আছেন কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। এটা অবশ্যই পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়ার ইঙ্গিত।’

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙেছেন। কোনো হুমকি বা প্রচারণা এই সত্য লুকাতে পারবে না যে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পথে ইউক্রেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ এবং দিনের পর দিন একটা বিচ্ছিন্ন দেশ হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে রাশিয়া।    

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ এই হুমকি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র আছে, এমন দেশের জন্য এটা দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা বক্তব্য। তবে সাত মাস ধরে তিনি যেভাবে কথা বলে আসছেন, তাতে এটা (সেনা সমাবেশ করার ঘোষণা) অস্বাভাবিক নয় এবং আমরা এটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যথাসম্ভব আমরা তাদের (রাশিয়ার) কৌশলগত হুমকির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে এই মুহূর্তে এ নিয়ে কিছু করার প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত আমরা পাইনি।’ রাশিয়া থেকে নতুন করে আরও তিন লাখ রিজার্ভ সেনা সমাবেশ করার পুতিনের এ ঘোষণাকে তাঁর দুর্বলতা মনে করছেন জন কিরবি।

এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে রাশিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগারে হাত দিলে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এর জবাব দেবে। বাইডেন বলেছিলেন, ‘এর পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। শুধু তিনি (পুতিন) বিশ্বমঞ্চে একঘরে হয়ে পড়বেন না, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর কঠিন জবাব দেবে। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।’

জার্মানি

জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হেবেক বলেছেন, ‘রাশিয়ার দিক থেকে এটা আরও একটি খারাপ ও ভুল পদক্ষেপ। কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানানো যায় কিংবা মোকাবিলা করা যায়, আমরা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।’

জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, রাশিয়ার আংশিক সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে ইউক্রেনে হামলার এ ইঙ্গিত সফল হবে না বলে মনে করছেন জার্মান চ্যান্সেলর।

ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)

ইইউর একজন নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, পুতিনের আংশিক সেনা সমাবেশ করার এই ঘোষণা প্রমাণ করে যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এখন বেপরোয়া ও উন্মাদ হয়ে উঠেছেন এবং তিনি এই সংকট কীভাবে আরও ঘনীভূত করা যায়, সেই চেষ্টাই চালাচ্ছেন।  

ইউরোপীয় কমিশনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিভাগের মুখপাত্র পিটার স্ট্যানো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পুতিন যে শান্তিতে বিশ্বাসী নন, এটা তার আরও একটি উদাহরণ। আগ্রাসনের এই যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ুক, সে বিষয়ে তিনি বেশি আগ্রহী।’

চীন

পুতিনের এমন ঘোষণার পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব পক্ষের নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়গুলো সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে। সে জন্য সবাইকে একসঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে পরামর্শ দিয়েছে তারা।

এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বুধবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে চীন তার আগের অবস্থানে আছে এবং এই অবস্থান স্পষ্ট।