ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালিয়ে রুশ নাগরিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ড্রোন হামলার ভয়ংকর ভিডিও এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোসহ নিয়মিতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন তাঁরা। রাশিয়ায় তাঁরা ‘জেড ব্লগার’ নামে পরিচিত।
বিবিসির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাশিয়ার যুদ্ধের পক্ষে থাকা এ ব্লগাররা প্রচারণা চালিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে প্রচুর বিজ্ঞাপন পাচ্ছেন এবং এর থেকে তাঁদের প্রচুর আয় হচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে শুরু করে ফ্যাশন পর্যন্ত সব অঙ্গনের বিজ্ঞাপনই তাঁরা শেয়ার করেন।
যুদ্ধের প্রতি এসব ব্লগারদের সমর্থনকে সাধারণত ‘জেড’ অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এ কারণে তাঁদের জেড ব্লগার নামে ডাকা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ব্লগার রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। তাঁরা সম্মুখযুদ্ধের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে থাকেন। তাঁরা তরুণ রুশ নাগরিকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং টুইটার নিষিদ্ধ করায় রুশ নাগরিকদের অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রাম ব্যবহার করে থাকেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পুরোদমে অভিযান শুরুর পর যুদ্ধের সপক্ষের ব্লগারদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে লাখ লাখ অনুসারী যুক্ত হয়েছে।
ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ায় টেলিগ্রাম চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের বাজারও বেড়েছে। আর এরই সুযোগ নিচ্ছেন জেড ব্লগাররা। তাঁরা বিজ্ঞাপনের জন্য নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলের জায়গা বিক্রি করছেন। যেসব কোম্পানি তরুণ গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে চাচ্ছে, তারা এসব মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন বাবদ কে কত নিচ্ছেন
বিজ্ঞাপন বাবদ কত অর্থ নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে বিবিসির গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন দলের সদস্যেরা অনুসন্ধান চালান। হোটেলমালিক সেজে তাঁরা কয়েকজন প্রথম সারির জেড ব্লগারের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁরা (বিবিসির প্রতিনিধিরা)।
‘জেড ব্লগার’দের একজন আলেক্সান্দার কৎস। তিনি রাশিয়ার সরকারপন্থী একটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধি। পরে যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা এবং মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা শুরু করেন। তাঁর ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম চ্যানেলে ছয় লাখের বেশি অনুসারী আছে।
হোটেলমালিক সেজে যাওয়া বিবিসির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলেক্সান্দার কৎসের কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁর চ্যানেলে বিজ্ঞাপন হিসেবে দেওয়া প্রতিটি পোস্টের জন্য ৪৮ থেকে ৭০ হাজার রুবল (৪৪০ থেকে ৬৮০ পাউন্ড) দিতে হবে। টেলিগ্রাম চ্যানেলের ফিডের ওপরের দিকে কত সময় পর্যন্ত বিজ্ঞাপনটি রাখা হবে, তার ওপর দাম কমবেশি হওয়া নির্ভর করে।
সেমিয়ন পেগভ (ওয়াগনজো নামে পরিচিত) নামের আরেকজন যুদ্ধ–ব্লগার আছেন। তিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিত জেড ব্লগার। তাঁর ১৩ লাখের বেশি অনুসারী আছে। পেগভ বলেন, তিনি বিজ্ঞাপন হিসেবে দেওয়া প্রতিটি পোস্টের জন্য ১ হাজার ৫৫০ পাউন্ড সমমূল্যের অর্থ আয় করেন।
রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোর সঙ্গে কাজ করেন, এমন এক বিজ্ঞাপন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তিনি বলেন, গ্রে জোন নামের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রতিটি বিজ্ঞাপন থেকে ২৬০ পাউন্ড সমমূল্যের আয় হয়। এ টেলিগ্রাম চ্যানেলটি ভাগনারের সঙ্গে ভালোভাবে সম্পৃক্ত। তাদের ৬ লাখের বেশি অনুসারী আছে।
প্রয়াত ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের প্রতিষ্ঠিত রিয়া ফ্যান ওয়েবসাইটের প্রতিনিধি আলেক্সান্দার সিমোনভের টেলিগ্রাম চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বাবদ দেওয়া প্রতি পোস্টের জন্য ১৮০ পাউন্ড দিতে হয়।
রিয়া ফ্যানের আরেক প্রতিনিধি আলেক্সান্দার ইয়ারেমচুকের অনুসারীরসংখ্যা খুব বেশি নয়। এ কারণে তাঁর বিজ্ঞাপনমূল্যও কম। প্রতি পোস্ট বাবদ তিনি নেন ৮৬ পাউন্ড।
কিছুসংখ্যক জেড ব্লগারের যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার মতো উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা থাকলেও কারও কারও কোনো ধরনের পেশাদার প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ না থাকা এমন একজন জেড ব্লগার মারিয়ানা নাউমোভা। তিনি এখন জাতীয় টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
প্রভাবশালী যুদ্ধ–ব্লগারদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিবিসি। তবে আলেক্সান্দার কৎস ছাড়া আর কেউ সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। আলেক্সান্দার কৎস ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা শহর বাখমুতে নিযুক্ত আছেন। সেখান থেকেই তিনি বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন। নিজেকে তথ্যযুদ্ধের একজন প্রতিবেদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
আলেক্সান্দার কৎস বলেন, ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায়ই আমাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। গোপনে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো তাদের দেওয়ার জন্য সরাসরি মাধ্যম আছে। পর্দার পেছনের ঘটনা এগুলো। আর আমি এ কাজটিই করি।’
ভুয়া ভিডিও পোস্ট
যুদ্ধপন্থী ব্লগারদের পোস্ট করা কিছু ভিডিও ভুয়া থাকে।
মার্চের শেষের দিকে আলেক্সান্দার কৎসসহ কয়েকজন প্রভাবশালী জেড ব্লগার একটি ড্যাশ ক্যাম ভিডিও (গাড়িতে লাগানো ছোট ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও) পোস্ট করেছিলেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন ইউক্রেনীয় সেনা একটি গাড়িকে থামাচ্ছেন। ওই গাড়ির ভেতরে আছেন এক নারী এবং একটি ছোট শিশু। ওই ভিডিওতে আরও দেখা যায়, অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা রুশ ভাষায় কথা বলায় ওই নারীকে গালি দিচ্ছেন এবং ভয় দেখাচ্ছেন। জেড ব্লগাররা বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে ইউক্রেন সরকার কেমন আচরণ করছে, তা এ ভিডিও দিয়েই বোঝা যাচ্ছে।
পরে বিবিসির পক্ষ থেকে ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, ভিডিওটি দোনেৎস্কের কাছে মাকিভকা শহরে ধারণ করা। ইউক্রেনের এই এলাকা ২০১৪ সাল থেকে রুশ–সমর্থিত বাহিনীর দখলে আছে। দখল করা এ এলাকায় পোশাকধারী কোনো ইউক্রেনীয় সেনার পক্ষে কার্যক্রম চালানো অসম্ভব। তা ছাড়া ইউক্রেনে ড্যাশ ক্যাম ব্যবহার করা অবৈধ।
গাড়িতে যে ক্রসটি দেওয়া ছিল, তা ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহৃত ক্রসের চেয়ে ভিন্ন। এ বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, ভিডিওটি সাজানো।
তরুণ রুশ নাগরিকদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জেড ব্লগাররা যে অনেক ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছেন, তারই একটি নমুনা এটি।
যুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানো এসব জেড ব্লগারদের প্রশংসা করে আসছেন পুতিন। তিনি আলেক্সান্দার কৎসকে প্রেসিডেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক পরিষদে নিয়োগ দিয়েছেন। সেমিয়ন পেগভ এবং আরও কয়েকজন ব্লগারকে বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণকে সংগঠিত করাসংক্রান্ত কার্যনির্বাহী দলের সদস্য করেছেন।
জুনে ক্রেমলিনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি যুদ্ধপন্থী ব্লগার এবং রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই বৈঠক দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল।