আফ্রিকায় প্রিগোশিনহীন ভাগনারের কী হবে
ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। নিহত হওয়ার আগে প্রিগোশিন ‘আফ্রিকাকে আরও মুক্ত’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালিতে একটি ভিডিও চিত্রায়িত করেছিলেন। এবার সেই মালি ছেড়েছে ভাগনার।
প্রিগোশিনের নিহত হওয়ার বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। এই কারণে আফ্রিকার সরকার, যারা ভাগনারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু আফ্রিকান সরকার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিকল্প আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। এর পর থেকে প্রিগোশিনের ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে।
সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকের (সিএআর) প্রেসিডেন্ট ফাউস্টিন-আর্চেঞ্জ তোয়াদেরা ২০১৮ সালে প্রথম মিলিশিয়ার দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু সাহেল অঞ্চলে সামরিক দখলদারি দেখে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ভাগনারের শরণাপন্ন হয়েছে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সাহেল ও সেন্ট্রাল আফ্রিকাজুড়ে দ্রুত আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। তাদের উত্থান সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সঙ্গে মিলে যায়, যা এখনো এই অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে।
প্রিগোশিন এই গ্রুপের অপারেশনের সম্মুখে ছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তাঁর মৃত্যু আফ্রিকায় ভাগনারের ওপর খড়্গ লাগিয়ে দেবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ভাগনারের একটি আসন্ন বইয়ের লেখক জন লেচনার বলেছেন, ‘প্রিগোশিন নিজেই অবিশ্বাস্যভাবে সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন। তিনি তাঁর জীবনের চেয়েও অনেক বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায়িক ক্ষমতা ছিল প্রবল।’
ভাগনারের সম্প্রসারণ কি অব্যাহত থাকবে
দুই মাস আগে, গত জুনে প্রিগোশিন বিদ্রোহ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। মূলত তখন থেকেই প্রিগোশিনের সামরিক-ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কালো মেঘ নেমে আসে। সেই সময় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছিলেন, গ্রুপটির কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
তবে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন ও তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড দিমিত্রি উৎকিন নিহত হওয়ার খবর আসার পর এখন ভাগনারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আফ্রিকা প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ক্যামেরন হাডসন বলেছেন, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকে যেহেতু আগে থেকেই চুক্তি করা ছিল, তাই এই অঞ্চলে ভাগনারের সিদ্ধান্তের খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই। রাশিয়ানরা বলেছিলেন, তাঁরা ওই চুক্তিগুলোর প্রতি সম্মান জানাবেন। প্রশ্ন হলো, বুরকিনা ফাসো ও নাইজারের মতো দেশগুলোতে ভাগনার তাদের উপস্থিতি প্রসারিত করার চেষ্টা করছিল—এখন সেসব দেশে এই প্রচেষ্টার কী হবে? রাশিয়ার সরকারের অধীন কি সেই সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকবে?
গত জুন মাসে রাশিয়ায় ভাগনারের সংক্ষিপ্ত বিদ্রোহ ছিল ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে প্রিগোশিন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভেদের চূড়ান্ত পরিণতি। তবে আফ্রিকার সরকারগুলোর এই ভাড়াটে গোষ্ঠী ও রাশিয়া সরকারের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক আচরণ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
মালির অভ্যুত্থানকারীরা সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ‘রাশিয়ান প্রশিক্ষক’ হিসেবে উল্লেখ করে যাচ্ছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের সিএআরের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক চার্লস বোয়েসেল আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘এসব নিয়ে সিএআর কর্তৃপক্ষ সব সময় অস্বস্তিতে ছিল।’
চার্লস বোয়েসেল আরও বলেন, ‘তাঁরা জানতেন না যে ভাগনারের সহায়তার জন্য কার প্রশংসা করতে হবে। কখনো তারা রাশিয়ান কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, আবার কখনো প্রিগোশিনকে ধন্যবাদ দিচ্ছে।
তবে তারা যা চায় তা হলো, রাশিয়ার সহায়তা অব্যাহত থাকুক এবং তারা তাদের মতামত প্রকাশে সতর্ক থাকবে [প্রিগোশিনের মৃত্যুতে]।’
অস্বীকৃতির মাত্রা
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাশিয়ার প্রতি ছিল, ভাড়াটে গোষ্ঠীর প্রতি নয়। সিএআরের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ফিদেল গোয়ান্দজিকা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, প্রিগোশিনের মৃত্যু মস্কোর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের পরিবর্তন করবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যদিও প্রিগোশিন নিজে অনুপস্থিত থাকবেন, তবে ক্রেমলিন এই মহাদেশেও তার প্রভাব বজায় রাখা নিশ্চিত করবে।
জন লেচনার বলেছেন, আফ্রিকায় রাশিয়ার উপস্থিতি থেকে অনেক রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান উপকৃত হচ্ছে। এ কারণে তারা সেই সম্পর্কগুলো অটুট থাকুক, তা চাইবে।
যাহোক, ভাগনার ও রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব আফ্রিকান সরকার এবং রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে পারে।
ক্যামেরন হাডসন বলেন, ‘আমার ধারণা, তারা তাদের পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করতে যাচ্ছে… যেসব দেশ ভাগনারের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করছে, তারা মস্কোর সঙ্গে একই ধরনের সম্পর্ক চায় কি না, সেটা নিয়ে ভাববে। কারণ, ভাগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের কিছুটা অস্বীকার নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল।’
আবদ্ধ পরিবেশ
নাইজারের দিকে ভাগনারের সর্বশেষ দৃষ্টি ছিল। প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড ক্ষমতা দখল করার পর থেকে দেশটি পশ্চিমের নজর থেকে ছিটকে পড়েছে। আঞ্চলিক ব্লক ইকোওয়াস গত ২৬ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অপসারিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে পুনরুদ্ধারে দেশটিতে আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছে।
প্রিগোশিনের মৃত্যুতে ভাগনারের সামরিক সহায়তা চাওয়া নতুন দেশগুলোর কাছে ভাগনারের আবেদন কমে যেতে পারে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সামরিক শক্তি এখনো নতুন অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করতে পারে।
জন লেচনার বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রিগোশিনের মৃত্যুর পরও যদি ভাগনার নাইজারে ঢুকে যায়, তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা এখনো একটি আবদ্ধ পরিবেশে আছি, যেখানে নিরাপত্তার বিষয়ে বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের জন্য আফ্রিকার সরকারগুলোর কাছে অপেক্ষাকৃত কম বিকল্প রয়েছে।’
নাইজেরিয়ার ভূরাজনৈতিক উপদেষ্টা সংস্থা এসবিএমের গণনা অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে থেকে আফ্রিকায় ৯টি অভ্যুত্থান হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ১৫টি ইকোওয়াস সদস্যদেশের মধ্যে ৫টি এখন সামরিক শাসনের অধীনে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অভ্যুত্থানের ধারাটি ভাড়াটে গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি কৌশল। কারণ, সামরিক সরকারগুলো পশ্চিমা চাপের মধ্যে ক্ষমতার ওপর তাদের দখল সুসংহত করার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন এই ধরনের ব্যক্তিগত সামরিক হস্তক্ষেপকে আমন্ত্রণ জানাতে থাকবে।
ক্যামেরন হাডসন বলেছেন, ‘আফ্রিকার অবৈধ সরকারগুলোর তাদের ক্ষমতা ও শাসনের জন্য নিরাপত্তা সহায়তা প্রয়োজন।’