ব্রেক্সিট থেকে পার্টি গেট কেলেঙ্কারি: বরিস জনসনের উত্থান-পতন

বরিস জনসন
ফাইল ছবি: এএফপি

রক্ষণশীল দলের রাজনীতিতে নেমে তরতর করে এগিয়ে গেছেন। একসময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন রক্ষণশীল দলের নেতা বরিস জনসন। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই যেন সবকিছু ওলটপালট হতে থাকে। একের পর এক বিতর্কে জড়াতে থাকেন তিনি। করোনাকালে বিধি লঙ্ঘন করে পার্টি আয়োজন করে বিতর্কিত হন। এমন আরও নানা কেলেঙ্কারির কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। সেটাও বছরখানেক আগের কথা। এবার পার্লামেন্ট থেকেও পদত্যাগ করেছেন কনজারভেটিভ দলের এই নেতা।

করোনাবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বরিসের বিরুদ্ধে তদন্ত চলা অবস্থাতেই গতকাল শুক্রবার ৫৮ বছর বয়সী এই নেতা অভিমান করে পার্লামেন্টের সদস্য পদও ছেড়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় করোনাবিধি ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে বরিস বারবার পার্লামেন্টে মিথ্যা বলেছেন কি না, তা নিয়েই ওই তদন্ত হচ্ছিল। বরিস একে ক্যাঙারু কোর্ট হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বরিস বলেন, ‘পার্লামেন্ট ছেড়ে আসাটা অত্যন্ত বেদনার বিষয়, অন্তত এমন এক সময়ে। তবে আমাকে যেভাবে জোরপূর্বক ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট উপায়ে পদচ্যুত করা হয়েছে, তাতে আমি হতভম্ব হয়েছি।’

দায়িত্ব গ্রহণ, নানা বিতর্ক অতঃপর পদত্যাগ

ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন টোরি দল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়। এরপর পার্লামেন্টের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার চুক্তিটি অনুমোদন করান তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে কয়েক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হয়।

ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে সক্ষম হলেও করোনা মহামারি পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি বরিস জনসন। পার্টি গেট কেলেঙ্কারিসহ (লকডাউনবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ) বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কারণে গত বছরের জুলাইয়ে মন্ত্রীদের বিদ্রোহের মুখে পড়েন তিনি। এমন অবস্থায় তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।

তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের পরও গুঞ্জন ওঠে, জনসন হাল ছাড়বেন না। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তিনি আবারও লড়বেন।

তবে জনসনের বিরুদ্ধে এসব বিতর্ক নতুন কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে বিতর্কে জড়ান তিনি।

‘দাম্ভিকতা’

ব্যক্তিগত জীবনে বরিস জনসন তিনটি বিয়ে করেছেন। তাঁর সন্তান আটজন।

ইটন কলেজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন বরিস জনসন। ইটনে শিক্ষকদের কাছে তিনি দাম্ভিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বরিস চাইতেন, তাঁকে যেন ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বরিস জনসনের মনোভঙ্গি এমন ছিল যে যত নিয়ম সব অন্য মানুষের জন্য।

অক্সফোর্ডে পড়াশোনার সময় বরিস অক্সফোর্ড ইউনিয়ন নামের ডিবেটিং সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর তিনি প্রথম বিয়ে করেন সহপাঠী আলেগ্রা মস্টিন-ওয়েনকে। তবে ওই বিয়েতে ওয়েনের মায়ের আপত্তি ছিল।

প্রথম স্ত্রীর মা গাইয়া সেরভেদিও বলেছিলেন, তিনি (বরিস জনসন) ডানপন্থী, এটা আমি মানতে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর চালচলন আমার পছন্দ ছিল না। তাঁর কাছে সত্য বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

গাইয়া সেরভেদিও ২০২১ সালে মারা গেছেন।

একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্র দ্য টাইমস থেকে বরিস জনসনকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এর পর তিনি দ্য টেলিগ্রাফে ব্রাসেলস প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৯৯০–এর দশকে ইইউ নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রক্ষণশীল ইউরো সংশয়বাদীদের উসকে দিতেন। যেমন তাঁর প্রতিবেদনে বলা হতো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ফেডারেল মেগা স্টেট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে, যা ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির।

বরিস জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা এসব প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাই করতেন। তাঁরা কিছু কিছু প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ ভুয়া’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

বরিস যেসব সুবিধা আদায় করেছেন

বরিস জনসন টেলিভিশনে ব্যঙ্গাত্মক কুইজ শো উপস্থাপনা করতেন এবং সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কলাম লিখতেন। আর এসবের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে এগুলোকে পুঁজি করেছিলেন তিনি।

২০০৪ সালে বরিস জনসন এমপি নির্বাচিত হন। তবে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা বলায় তৎকালীন টোরি নেতা মাইকেল হাওয়ার্ড তাঁর ছায়া মন্ত্রিসভা থেকে বরিসকে বরখাস্ত করেন।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি (বরিস) দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি নিজেকে ইইউপন্থী হিসেবে প্রচার করেছেন। তবে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হওয়া) প্রশ্নে গণভোটের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি তাঁর অবস্থান বদলে ফেলেন।

এরপর বরিস জনসন ‘লিভ’ বা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হওয়ার পক্ষের মানুষদের কাতারে নাম লেখান। এভাবে জনপ্রিয় হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন, যাকে পুঁজি করে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

দ্য টেলিগ্রাফে তাঁর সাবেক সম্পাদক ম্যাক্স হাস্টিংস মনে করেন, এটি হাস্যকর বিষয় হলেও তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরিস জনসন কারও স্বার্থের কথা না ভেবে নিজের খ্যাতি আর তুষ্টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসনের পদত্যাগের আগে দ্য টাইমসে হাস্টিংস লিখেছেন, তিনি (বরিস) শিষ্টাচারের প্রতিটি বিধি লঙ্ঘন করেছেন। ব্রেক্সিট ছাড়া অন্য কোনো নীতিমালা বাস্তবায়নে তিনি কোনো প্রচেষ্টাই চালাননি।

হাস্টিংস আরও লিখেছেন, কনজারভেটিভ দল যখন তাঁকে বেছে নিয়েছিল, তখনো তাঁর কোনো নৈতিকতা বোধ ছিল না। নিজের জীবনের মতো করেই কার্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি বিশৃঙ্খল।

আরও পড়ুন