বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের মানুষের মনে ভর করেছে যে ভয়
উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড। বাল্টিক সাগর উপকূলে দেশটির অবস্থান। দেশটির আয়তন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৫ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ৫৬ লাখ মানুষ বাস করে ফিনল্যান্ডে। ইউরোপের যেসব দেশে সবচেয়ে কম মানুষের বসবাস, সেই তালিকায় ফিনল্যান্ডের অবস্থান তৃতীয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি বিশেষ কারণে ফিনল্যান্ডের নাম বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। আর তা হলো, পরপর ছয়বার দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হওয়া সত্ত্বেও একটি ব্যাপার নিয়ে ফিনল্যান্ডবাসীর মধ্যে ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা লক্ষ করা যায়।
ফিনল্যান্ডবাসীর এই নিরাপত্তাহীনতার মূলে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। ফিনল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, রাশিয়া তাঁদের দেশে হামলা চালাতে পারে। ইউক্রেনের মতো ফিনল্যান্ডেও ঢুকে যেতে পারেন রুশ সেনারা।
এই নিরাপত্তাহীনতার প্রেক্ষাপটে ফিনল্যান্ড একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। বছরখানেকের চেষ্টার পর তারা গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে সক্ষম হয়েছে।
ফিরে দেখা
রাশিয়া ও ফিনল্যান্ড প্রতিবেশী। রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এই প্রতিবেশী দেশটিই ফিনল্যান্ডের মানুষের উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ। ফিনল্যান্ডের এই উদ্বেগ মোটেও অহেতুক নয়। কেননা, ১৯৩৯ সালে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই যুদ্ধ চলে প্রায় পাঁচ মাস।
ফিনল্যান্ডের ভূখণ্ডের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছিল সোভিয়েত বাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সোভিয়েত বাহিনী ফিনল্যান্ড থেকে পিছু হটে। তবে এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে আরও অনেক পর, ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে।
১৯৪৮ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ, কো-অপারেশন অ্যান্ড মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট নামের চুক্তি করে ফিনল্যান্ড। সে সময় থেকে নিরপেক্ষ থাকার নীতি গ্রহণ করে ফিনল্যান্ড। এই নীতির আলোকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত কোনো বলয়ে ছিল না দেশটি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় রাশিয়া। এই পর্যায়ে ইউরোপের অনেক দেশের মতো ফিনল্যান্ড ন্যাটোর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ১৯৯৪ সালে এই সামরিক জোটের সহযোগী বা ‘অফিশিয়াল পার্টনার’ হয় দেশটি। তবে ন্যাটোর পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়া নিয়ে দেশটির তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। একই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হয় ফিনল্যান্ড।
নানা বাঁকবদল সত্ত্বেও নিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলছিল ফিনল্যান্ড। তবে মস্কোর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিভিন্ন সময় ফিনল্যান্ডবাসীর মধ্যে রুশ ভীতি দেখা যায়।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে রাশিয়া। এই হামলার জেরে ফিনল্যান্ডের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়ে যায়।
রাশিয়া-ফিনল্যান্ডের সীমান্তে আগে কাঠের বেড়া ছিল। ভীতি থেকে সম্প্রতি এই সীমান্তে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে উদ্যোগী হয় ফিনল্যান্ড। গত মার্চে ফিনল্যান্ড সরকার জানায়, তারা রাশিয়ার সঙ্গে ২০০ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এই বেড়া হবে ১০ ফুট উঁচু।
সম্ভাব্য হামলা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দিতে রাজধানী হেলসিঙ্কিতে মাটির নিচে ‘লুকানো শহর’ বানানোর কথাও জানায় ফিনল্যান্ড। বলা হয়, যেকোনো যুদ্ধের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ মানুষ কয়েক মাস ধরে এই শহরে থাকতে পারবে।
ফিনল্যান্ডের অন্য স্থানেও এমন শহর বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। এ ছাড়া সম্ভাব্য হামলা থেকে জনগণকে বাঁচাতে ফিনল্যান্ডজুড়ে বানানো হয়েছে ৫ হাজার বোমা শেল্টার ও ৫০ হাজার বাংকার।
রুশ ভীতির বিষয়ে ফিনিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনালের গবেষক চ্যার্লি স্যালোনিয়াস-পাসটারনাক বলেন, একটি ঐতিহাসিক ধারণা আছে, সব সময় প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ, রাশিয়া যেকোনো সময় আক্রমণ চালাতে পারে।
নিরাপত্তার খোঁজে ন্যাটোয়
ন্যাটোর আর্টিকেল-ফাইভে বলা হয়েছে, যদি কোনো সদস্য দেশ সামরিক হামলা বা আগ্রাসনের শিকার হয়, তাহলে তা এই জোটের সব কটি দেশ নিজেদের ওপর হামলা বা আগ্রাসন হিসেবে দেখবে। এটি প্রতিহত করতে তারা সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেবে। মূলত নিরাপত্তা শঙ্কা থেকেই ন্যাটোর সদস্য হয়েছে ফিনল্যান্ড।
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে দেশটিকে সহায়তা দিয়ে আসছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। ন্যাটোর পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়ায় এখন ফিনল্যান্ডে আক্রমণের আগে রাশিয়া দ্বিতীয়বার ভাববে বলে মনে করে হেলসিঙ্কি।
ভীতি থেকে জনসমর্থন
ন্যাটোভুক্ত হওয়ার জন্য গত বছরের মে মাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক আবেদন করে ফিনল্যান্ড। সব বাধা কাটিয়ে আবেদনের প্রায় এক বছরের মাথায় ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হলো দেশটি।
ফিনল্যান্ডের জনগণ যে রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের ব্যাপারে ভীত, তার প্রমাণ মেলে দেশটির ন্যাটোভুক্ত হওয়ার উদ্যোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে।
ফিনল্যান্ড সরকার যখন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দেশটির ৫৩ শতাংশ মানুষ এতে সমর্থন দেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপর ফিনল্যান্ডের ৬৮ শতাংশ মানুষ ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। গত এক বছরে এই সমর্থন প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, সবচেয়ে সুখী দেশের মানুষেরা কতটা ভয়, উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এখন ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পর বাল্টিক সমুদ্র এলাকায় জোটটির সদস্য দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত। ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টি রাশিয়ার জন্য একটি ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নজর রাখবে রাশিয়া
ন্যাটোর সিদ্ধান্তের পর জোটটির মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ফিনল্যান্ড এখন নিরাপদ এবং আরও শক্তিশালী হবে।
অন্যদিকে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ন্যাটো কীভাবে ফিনল্যান্ডের ভূমি ব্যবহার করে, তার ওপর নজর রাখবে মস্কো। এর ওপর ভিত্তি করে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ন্যাটোতে যোগ দিলে বড় ভুল করবে ফিনল্যান্ড। এখন ফিনল্যান্ডে ন্যাটো কী করে আর পাল্টা হিসেবে রাশিয়া কী পদক্ষেপ নেয়, তা দেখার বিষয়। তবে ভবিষ্যতে উত্তেজনা যে বাড়বে, তার আলামত বিবদমান পক্ষগুলোর বক্তব্যে স্পষ্ট।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, রয়টার্স ও এনডিটিভি